বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। কিন্তু শিল্প ও পরিষেবা খাতে টানা মন্দার কারণে বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে তা নেমে আসে মাত্র ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশে। ফলে পুরো অর্থবছরে গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে—যা সাম্প্রতিক এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর ‘মাসিক সামষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগে স্থবিরতা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধীরগতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন “সংকটের কিনারায়” অবস্থান করছে।
গতকাল রাজধানীতে পিআরআই কার্যালয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়কালের সামষ্টিক অর্থনৈতিক চিত্র তুলে ধরেন পিআরআইয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবৃদ্ধিতে পতন
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম পর্যায়ে নেমে এসেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি—মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। উচ্চ সুদহার, কঠোর মুদ্রানীতি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসা সম্প্রসারণে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও মজুরি বৃদ্ধির হার পিছিয়ে থাকায় প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা দুর্বল হয়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ড. আশিকুর রহমান বলেন,
“বিনিয়োগ কিছুটা কমলেও এটিকে ধস বলা যাবে না। তবে অর্থনীতির গতি এখন খুবই সতর্ক পর্যায়ে।”
রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ও আর্থিক দুর্বলতা
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আহরণ ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশে। এতে সরকারের ব্যয় মেটানো ও উন্নয়ন খাতের অর্থায়নে চাপ বাড়ছে।
পিআরআইয়ের বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলার অভাব এবং অল্পসংখ্যক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতিতে নতুন ধরনের বৈষম্য তৈরি করছে।
ড. আশিকুর রহমান বলেন,
“ব্যাংক খাতে যে অলিগার্ক শ্রেণী তৈরি হয়েছিল, তারাই অর্থনীতির স্থবিরতার জন্য দায়ী। এখন প্রয়োজন সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি।”
কঠোর মুদ্রানীতি শিথিলের পরামর্শ
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ড. মনজুর হোসেন বলেন,
“বিনিয়োগ বাড়াতে হলে কঠোর মুদ্রানীতি কিছুটা শিথিল করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বজায় রেখে নীতি সুদে সামঞ্জস্য আনা জরুরি।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় না হলে প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে আরও শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা এখনো আছে
সব নেতিবাচক প্রবণতার মধ্যেও কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে। পিআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়—
-
ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি ১৭ মাস পর আবার দুই অঙ্কে পৌঁছেছে।
-
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলার হার গত অর্থবছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।
-
রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা এসেছে।
এই কারণে পিআরআই বিশ্লেষকরা আশা করছেন, চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে, যদিও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তা ৫ শতাংশের নিচে অনুমান করছে।
নীতিগত দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ করণীয়
পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার তার বক্তব্যে বলেন,
“বাংলাদেশের বাণিজ্য কাঠামো এখন পরিবর্তনের মুখে। তুলনামূলক সুবিধার বদলে শুল্ক সুবিধা নির্ভরতা বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো প্রবৃদ্ধিই টেকসই হবে না।”
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন—
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাসরুর রিয়াজ,
অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের ডেপুটি হেড অব মিশন জশুয়া গ্যাকুটান,
কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক,
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিক অ্যাডভাইজার ওয়াইস পেরি,
এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা।
সমাপ্তি:
বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতার সন্ধিক্ষণে। বিনিয়োগ, সুশাসন ও আর্থিক খাতের সংস্কারই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তা না হলে প্রবৃদ্ধির গতি আরও কমে গিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে পারে—এমনই সতর্কবার্তা দিল পিআরআই-এর বিশ্লেষণ।