সুন্দরবনসংলগ্ন নদী ও খালে শামুক ও ঝিনুকের ব্যাপক নিধন ও পাচার শুরু হয়েছে—এ বিষয়টি স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ ও বনকর্মীদের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একটি অসাধু চক্র প্রতিদিন ট্রলার ও নৌকায় ভরে শামুক আহরণ করে তা ট্রাকে বা ট্রলারে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করছে। স্থানীয়রা বলছেন, অর্থলাভের লোভে প্রান্তিক জেলেদের এ কাজে জড়ানো হচ্ছে; ফলে নদীর প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পড়ছে।
বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২১ অক্টোবর সকালে শাকবাড়িয়া নদীর তীর থেকে ৬৫০ কেজি শামুক উদ্ধার করা হয়। বন ও জলজ সম্পদ সংরক্ষণ সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে শামুক আহরণ ও পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন লঙ্ঘনকারী কর্মকাণ্ড দণ্ডনীয় অপরাধ।
শামুক নিধনের বাস্তব ক্ষতি: নদীর ‘প্রাকৃতিক ফিল্টার’ নষ্ট হলে কি হবে?
বন কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন—শামুক ও ঝিনুক নদীর তলদেশের মাটি ও পানির গুণগত মান বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলো নদীর প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবে কাজ করে, দূষণ কমায়, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং মাছ ও কাঁকড়ার খাদ্যচক্র বজায় রাখতে সহায়তা করে। নির্বিচার নিধন হলে নদীর জীববৈচিত্র্য ও জলের স্বচ্ছতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দীন বলেন,
“শামুক নিধন হলে শুধু এক প্রজাতির ক্ষতি হবে না—অন্তর্গত খাদ্যশ্রেণী ভেঙে যাবে, মৎস্যজীবিদের আহরণ ক্ষমতা কমবে এবং নদীর বাস্তুতন্ত্র দুর্বল হবে।”
গ্রামের কন্ঠ: দিনমজুর থেকে জেলে—সবাই উপার্জনের ফাঁদে
কয়রা ও শ্যামনগর এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্রান্তিক দরিদ্র মানুষেরা চাকরির অভাবে শামুক আহরণে লিপ্ত হচ্ছেন। কোথাও ট্রলারে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু ও শামুক একসঙ্গেই তোলা হচ্ছে; পরে বালু ধুয়ে ফেলে কেবল শামুক রেখে নেওয়া হয়। অনেকে জানেন না, এ কাজ আইনত নিষিদ্ধ।
কয়রার এক মহিলা আহরণকারী রেশমা বেগম বলেন,
“গাঙে কুড়িয়ে দিনে প্রায় এক শ কেজি শামুক পাই। প্রতি কেজি পাঁচ টাকায় বিক্রি করি—এই টাকায় ভাত জুটে যায়।”
আরেক স্থানীয়—কপোতাক্ষ তীরের শামিম হোসেন বলেন,
“বাইরের লোকেরা এসে কিনে নিয়ে যায়। আমরা বাধা দিলেও হুমকি দেয় তারা।”
স্থানীয়রা আরও জানান, কয়রার আমাদী ব্রিজের পাশে শামুকের স্তূপ পড়ে থাকে; চারপাশে পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—এ দৃশ্য পরিবেশগত বিপর্যয়েরই গল্প বলে।
প্রশাসন ও বনবিভাগের কার্যক্রম: অভিযান চলছে, কিন্তু চেইন পুরোপুরি ভাঙেনি
বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিমসহ কয়েকটি দল নিয়মিত টহল দিচ্ছে এবং অবৈধ মালামাল জব্দ করে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাদের কয়েকটি বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ শামুক উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে বনাঞ্চল সীমান্ত ছাড়িয়ে স্থানীয় লোকালয় ও ট্রানজিট জোনেও পাচারকারীরা সক্রিয়, যা কেবল বন বিভাগের এক্তিয়েতে নির্বাহ করা সমাধান নয়—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা জরুরি।
নাসির উদ্দীন বলেন,
“জয়েন্ট অপারেশন না করলে কেবল বন বিভাগই সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না; স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশগ্রহণ ছাড়া এই অবৈধ চক্র বন্ধ করা কঠিন।”
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ও সমাধান পরামর্শ
কয়েকজন পরিবেশবিজ্ঞানী ও স্থানীয় সংগঠনের সদস্যরা বলছেন—শামুকের ব্যাপক নিধন হলে নদীর পানি দূষণ বাড়বে, উর্বরতা কমে যাবে এবং মাছ ও কাঁকড়ার প্রজননস্থান হ্রাস পাবে। উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতি ও ঐতিহ্যিক জীবিকা-উপায়ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন,
“এই পাচারের পেছনে ব্যবসায়ী ও অর্থদাতাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রান্তিক জেলেদের সচেতন করা ও বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করে দেওয়া জরুরি।”
কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা সতর্ক করেন—
“নদীর খাদ্যচক্র ভেঙে গেলে দীর্ঘমেয়াদে কৃষিকাজ ও মৎস্যচাষের ওপরই প্রভাব পড়বে; তাতে স্থানীয় আয়-উপার্জন ঝুঁকিতে পড়বে।”
বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ—কী করা উচিত?
-
জয়েন্ট টাস্কফোর্স গঠন: বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও পুলিশ মিলিয়ে দ্রুত যৌথ অভিযান কঠোরভাবে চালাতে হবে।
-
পাঠ্য ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি: প্রান্তিক জেলেদের জন্য বিকল্প আয়ের সুযোগ (দক্ষতা প্রশিক্ষণ, গৃহশিল্প/কৃষি সহায়তা) দিতে হবে।
-
বণিক শৃঙ্খল ভাঙা: শামুক সংগ্রহ-বিতরণে লিপ্ত চক্র ও পরিবহণকারীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
-
কমিউনিটি সচেতনতা কর্মসূচি: স্থানীয় পর্যায়ে মাইকিং, স্কুল-কলেজ ও বাজারে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম জরুরি।
-
দণ্ডনীয়তার বাস্তবায়ন: পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ ও জলজ সম্পদ সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে—তারই মাধ্যমে ভবিষ্যতে নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হবে।
শেষ কথা
শামুক কেবল একটি সামুদ্রিক অনুষঙ্গ নয়—এটি নদীর জলজ জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যবসায়িক লোভ ও দারিদ্র্যের সংমিশ্রে গঠিত এই অবৈধ চক্র না থামালে সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন নদনদীর একান্ত প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের মুখে পড়বে। সম্মিলিত সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও বিকল্প কর্মসংস্থান ছাড়া এই ক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়।
আসুন—স্থানীয় সম্প্রদায়, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ মিলে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেই; নয়তো সুন্দরবনের গহ্বর হারিয়ে যাবে—সেই ক্ষতি পূরণ করা হবে না।