ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটি–এর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া উত্তেজনা এক পর্যায়ে রূপ নেয় সহিংসতায়। এতে অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটির একাধিক যানবাহন।
সংঘর্ষের সূচনা এক থুতু ফেলার ঘটনায়
রোববার (২৬ অক্টোবর) রাত ৯টার দিকে আশুলিয়ার খাগান এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, সন্ধ্যার পর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ভাড়া বাসা ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস হোস্টেল’-এর পাশে বসেছিলেন সিটি ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থী।
এ সময় তাঁদের মধ্যে একজন অসর্তকতাবশত থুতু ফেললে তা ড্যাফোডিলের এক শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। বিষয়টি নিয়ে সামান্য কথা-কাটাকাটির পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু রাত নামতেই শুরু হয় হামলা।
সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী দেশি অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে ওই মেসে হামলা চালায়। তারা কক্ষ ভাঙচুর করে এবং কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখান।
রাতভর সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগ
পরে উভয় পক্ষের শত শত শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে আশুলিয়ার খাগান ও বাইপাইল এলাকায়।
ড্যাফোডিলের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, সিটি ইউনিভার্সিটির দিক থেকে হামলা চালানো হলে তাঁরা আত্মরক্ষায় একত্র হন।
এই সময় সিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে তিনটি বাস ও একটি প্রাইভেটকারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আরও দুটি প্রাইভেটকার, একটি মোটরসাইকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ভাঙচুর করা হয়।
রাত ১১টার দিকে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অবস্থান
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন,
“অসর্তকতাবশত সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর ফেলা থুতু ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। তখন ‘সরি’ বলায় বিষয়টি মিটে গিয়েছিল। কিন্তু রাতে এসে মেসে হামলার ঘটনাটি দুঃখজনক। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই আমাদের সন্তান। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।”
অন্যদিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ বলেন,
“ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, তা আমরা যাচাই করছি। ছাত্রদের মধ্যে মারামারি থেকে ক্যাম্পাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা হতে পারে না—এটি পরিকল্পিত হামলার ইঙ্গিত দেয়।”
ড্যাফোডিলের প্রক্টর শেখ মুহাম্মদ আলি জানান,
“এখনো আমাদের ৯ জন শিক্ষার্থীকে সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা আলোচনা চালাচ্ছি। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক ও মানবিক ক্ষতি
ঘটনার পর সোমবার সকাল পর্যন্ত আশুলিয়া এলাকার পরিবেশ ছিল উত্তেজনাপূর্ণ।
উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, বিশেষ করে আবাসিক হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা রাত কাটিয়েছেন ভয়ে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,
“রাতভর রাস্তায় আগুন আর ধোঁয়ার গন্ধে এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ছিল।”
বিশ্লেষণ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতার পুনরাবৃত্তি
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র বিরোধ বড় সহিংসতায় রূপ নেওয়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশের একটি পুনরাবৃত্ত চিত্র।
তারা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহাবস্থান, মানবিক মূল্যবোধ ও সংলাপের চর্চা জোরদার না করলে ভবিষ্যতেও এমন সংঘর্ষ থামানো কঠিন হবে।
একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন,
“একটি থুতু ফেলা থেকে দেড় শতাধিক তরুণের রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের সামাজিক সহনশীলতার চরম সংকেত।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, তদন্ত চলছে
পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঘটনায় কারা জড়িত এবং কীভাবে সহিংসতা ছড়াল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।