রাজধানীর ব্যস্ত ফার্মগেট এলাকায় রোববার দুপুরের সূর্য ছিল ঝলমলে। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই আলো ঢাকা পড়ে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনার ছায়ায়। মেট্রোরেলের একটি ৮০ কেজি ওজনের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে নিচে পড়ে প্রাণ কেড়ে নিল এক তরুণের। এই দুর্ঘটনা কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়—এটি প্রশ্ন তুলছে কোটি মানুষের নিরাপত্তা, আধুনিক নগরায়ণের মান ও জবাবদিহির কাঠামো নিয়ে।
এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার মেট্রোরেলে এটি দ্বিতীয়বারের মতো একই ধরনের দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটেই প্রথমবার খুলে পড়েছিল মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড। তখন ভাগ্যক্রমে কেউ হতাহত হননি, কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল টানা ১১ ঘণ্টা। আজকের ঘটনায় সেই দুঃস্বপ্ন ফিরে এল আরও ভয়াবহভাবে।
কী এই বিয়ারিং প্যাড?
বিয়ারিং প্যাড হচ্ছে রাবার ও স্টিলের মিশ্রণে তৈরি একধরনের সুরক্ষা উপাদান, যা মেট্রোরেলের উড়ালপথের (ভায়াডাক্ট) ওজন ও কম্পন ধারণে সাহায্য করে। এটি পিলার ও ভায়াডাক্টের মাঝখানে বসানো থাকে, যাতে কংক্রিটের ঘর্ষণে ক্ষয় বা ফাটল না ধরে। প্রতিটি স্প্যানে চারটি করে প্যাড থাকে—অর্থাৎ মেট্রোরেলের ৬২০টি পিলারে মোট ২,৪৮০টি প্যাড ব্যবহৃত হয়েছে।
দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানিয়েছে, পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে থাকা এই প্যাড কোনো নাট-বল্টু দিয়ে আটকানো থাকে না; বরং উপরের ভারী কাঠামোর চাপেই স্থিতিশীল থাকে। প্রশ্ন হলো—কোটি কোটি টাকার এই প্রকল্পে সেই ভারের ভারসাম্য কীভাবে হারাল?
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, “এটা নিঃসন্দেহে নকশাগত ত্রুটি। যেকোনো প্রকৌশল কাঠামোতে কম্পন ও ভারবহন একটি স্বাভাবিক বিষয়। সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার। সেটা না থাকলে এটি মানবজীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।”
তিনি আরও বলেন, “জাপানের প্রযুক্তি ও পরামর্শক দিয়ে তৈরি প্রকল্পে একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা কেবল দুঃখজনক নয়, এটি দায়বদ্ধতার বড় প্রশ্নও তোলে।”
ফার্মগেটেই কেন বারবার দুর্ঘটনা?
ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, এবারের ঘটনাটি ঘটেছে ৪৩৩ নম্বর পিলারে, যা ফার্মগেট স্টেশনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। গত বছর পড়েছিল ৪৩০ নম্বর পিলারের প্যাড। দুটি স্থানই একই বাঁক ও উচ্চতার কাছাকাছি অবস্থানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানকার রেললাইন উঁচু ও বাঁকানো হওয়ায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। তবে এটি শুধুমাত্র কারণ নয়, বরং প্রকৌশলগত দুর্বলতা বড় ভূমিকা রাখছে।
তদন্ত ও প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেতু সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, “কেন প্যাড খুলে পড়ল, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি নকশার ত্রুটি না অবহেলা—সবই তদন্তে পরিষ্কার হবে।”
মানবিক ক্ষতি ও নগরবাসীর উদ্বেগ
যে যুবকটি প্রাণ হারালেন, তার পরিবারের জীবনে শোকের পাশাপাশি এসেছে দীর্ঘ অনিশ্চয়তা। ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা সময়ই বলবে।
এদিকে ঢাকাবাসী আবারও আশঙ্কায়—যে মেট্রোরেল তাদের জীবনে গতি এনেছিল, সেটাই এখন মৃত্যুঝুঁকির আরেক নাম হয়ে উঠছে কি না।
একটি ব্যয়বহুল নিরাপত্তার মূল্য
৩৩ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি ছিল নাগরিক স্বপ্নের প্রতীক। প্রতি কিলোমিটারে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে তৈরি হয়েছে এই রেললাইন। কিন্তু যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়, তবে এই উন্নয়ন মানুষের জন্য নয়, বরং বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অধ্যাপক সামছুল হক যেমন বলেন, “নগরায়ণ তখনই টেকসই, যখন তা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। নকশা যত উন্নতই হোক, যদি তাতে প্রাণহানি ঘটে—তাহলে সেটি প্রকৌশল নয়, একটি মানবিক ব্যর্থতা।”