বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাগুলোর একটিতে আত্মসমর্পণ করেছেন সেনাবাহিনীর ১৫ কর্মকর্তা। তাঁরা আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন এবং বলেছেন—এই মামলার প্রকৃত অপরাধীরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছেন।
আজ বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ শুনানি শেষে তাঁদের ঢাকার সেনানিবাসের সাবজেলে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
আদালতে আত্মসমর্পণ ও শুনানি
ট্রাইব্যুনালে আসামি হিসেবে হাজির হন ১৫ জন সেনা কর্মকর্তা। শুনানি শেষে তাঁদের আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন,
“এই অফিসাররা দেশের আইনকে শ্রদ্ধা করে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁরা অভিজ্ঞ, সিনিয়র কর্মকর্তা—আন্তর্জাতিক মিশনেও কাজ করেছেন। তাঁরা আশা করছেন, আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন।”
সরোয়ার হোসেন আরও বলেন,
“মূল অপরাধীরা ভারতে পালিয়েছে—জেনারেল কবির, জেনারেল আকবর, জেনারেল তারিক সিদ্দিকী ও জেনারেল মুজিবসহ কয়েকজন এই মামলার প্রকৃত অভিযুক্ত।”
গ্রেপ্তার না আত্মসমর্পণ?
প্রসিকিউশন জানিয়েছিল, এই সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী দাবি করেন,
“তাঁরা কখনো গ্রেপ্তার হননি। সেনা সদর আগেই জানিয়েছিল, তাঁরা আর্মির হেফাজতে আছেন। পরে আইন মেনে স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।”
যাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন
এই ১৫ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন—
মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, কামরুল হাসান, মাহাবুব আলম, মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী, কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেদোয়ানুল ইসলাম ও মেজর রাফাত-বিন-আলম।
অভিযোগের পটভূমি
গত ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত গুম-নির্যাতন সংক্রান্ত দুই মামলা এবং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত একটি মামলা মিলিয়ে মোট ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
একই দিনে প্রসিকিউশন দাখিল করে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ)। পরবর্তীতে ১১ অক্টোবর সেনা সদর থেকে জানানো হয়, ১৫ কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
অন্য আসামিরা
এই তিন মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তাঁদের মধ্যে আল–মামুন বর্তমানে কারাগারে আছেন।
আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন,
“সাবেক আইজিপি আল–মামুন আদালতে স্বীকার করেছেন—সব নির্দেশনা এসেছিল শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে। অন্য কর্মকর্তাদের এতে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।”
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্ক
এই মামলাগুলো এখন শুধু আইনি বা রাজনৈতিক নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে হাজারো মানুষ গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
ট্রাইব্যুনাল এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করায় অনেক ভুক্তভোগী পরিবার এখন আশার আলো দেখছেন, যদিও আসামিপক্ষ বলছে—এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ।
পরবর্তী ধাপ
এই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ নভেম্বর ২০২৫।
সেদিন ট্রাইব্যুনালে পলাতক আসামিদের হাজির করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে।
সারাংশে
এই আত্মসমর্পণ দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিসরে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
যেখানে ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক দায় ও মানবতার প্রশ্ন—সব মিলেই এক জটিল বাস্তবতা তৈরি করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি সংবেদনশীল পর্ব।