• হোম > বাংলাদেশ > গুম-খুন মামলায় ১৫ সেনা কর্মকর্তা কারাগারে

গুম-খুন মামলায় ১৫ সেনা কর্মকর্তা কারাগারে

  • বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৮
  • ৫৫

---

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন এক ঘটনা ঘটল বুধবার সকালে। গুম, খুন ও জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি পৃথক মামলায় বর্তমান ও সাবেক ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

বুধবার (২২ অক্টোবর) সকালে ট্রাইব্যুনাল–১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার এর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন। অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন,

“গ্রেফতার দেখানো ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। কোন কারাগারে রাখা হবে—তা কারা কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে।”

তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,

“আদালতের প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা প্রশংসনীয়। এটি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে।”


পৃথক মামলাগুলো ও আদালতের নির্দেশ

আলাদা তিনটি মামলায় এই ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

???? প্রথম দুটি মামলা গুম ও খুনের অভিযোগে দায়ের হয়, যেখানে বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও সাধারণ নাগরিক নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
???? তৃতীয় মামলাটি গত বছরের ১৮ ও ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় সংঘটিত কথিত গণহত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল একইসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের হাজির করার জন্য জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে।

গুমের দুই মামলার পরবর্তী শুনানি ২০ নভেম্বর, আর রামপুরার গণহত্যা মামলার শুনানি ৫ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।


কারাগার ঘোষণা ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট

সরকার এর আগেই ১২ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িক কারাগার ঘোষণা করেছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়—ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৫৪১(১) ও The Prisons Act, 1894 (IX of 1894) এর ধারা ৩(বি)-এর অধীনে
‘বাশার রোড সংলগ্ন এমইএস বিল্ডিং নং-৫৪’ কে সাময়িকভাবে কারাগার হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

তবে কোন উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার হবে—সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি।
এই ঘোষণার মাধ্যমে বোঝা যায়, সেনানিবাসের ভেতরে নিরাপত্তাজনিত কারণে একটি বিশেষ হেফাজত ব্যবস্থা রাখা হতে পারে।


কারাগারে পাঠানো সেনা কর্মকর্তাদের নাম

যেসব কর্মকর্তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে, তারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও গোয়েন্দা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাদের মধ্যে রয়েছেন—

  • র‍্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম,

  • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার,

  • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান,

  • ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম,

  • ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ,

  • কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে)।

র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান,
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন,
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম,
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেদোয়ানুল ইসলাম এবং
বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো. রাফাত-বিন-আলমও এর মধ্যে আছেন।

এছাড়া ডিজিএফআইয়ের সাবেক তিন পরিচালক—
মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন,
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকীকেও কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


ঘটনার প্রেক্ষাপট

এর আগে ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুম ও খুনের অভিযোগে ৩০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
এর মধ্যে ছিলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক ৫ প্রধানসহ ২৫ জন সেনা কর্মকর্তা।

এটি বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা, কারণ চাকরিরত অবস্থায় এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আগে কখনো জারি হয়নি।

পরোয়ানার পর ১১ অক্টোবর সেনা সদর থেকে জানানো হয়—চার্জশিটভুক্ত ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এরপর ১২ অক্টোবর সেনানিবাসের ভবনটিকে সাময়িক কারাগার হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা ১৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা-১ শাখা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়।


মানবিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ

এই মামলাগুলো শুধু আইনি বিষয় নয়, বরং মানবিক বিচার ও জবাবদিহির প্রশ্নও উত্থাপন করছে।

দীর্ঘদিন ধরে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা এখন আদালতের এই পদক্ষেপে ন্যায়বিচারের নতুন আশার আলো দেখছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এটি “দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার সূচনা”, যা ভবিষ্যতে মানবাধিকার সুরক্ষায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এক ভুক্তভোগীর পরিবার জানান—

“বছরের পর বছর আমরা শুধু অপেক্ষা করেছি। আজ আদালতের পদক্ষেপে মনে হচ্ছে, সত্য একদিন সামনে আসবেই।”


উপসংহার

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতিহাসে এই রায় ও নির্দেশ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
এটি প্রমাণ করছে—রাষ্ট্র বা ক্ষমতার অবস্থান যাই হোক না কেন, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারই শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ মূল্যবোধ।

এই বিচারের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও মানবিক মর্যাদার নতুন ভিত্তি গড়ে উঠবে—এমন প্রত্যাশা করছে মানবাধিকার ও আইনি মহল।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/5793 ,   Print Date & Time: Wednesday, 26 November 2025, 10:05:36 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh