রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার জাহানাবাদ ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম চান্দোপাড়া এখন পরিচিত ‘আদা গ্রাম’ নামে। একসময় এই গ্রামে নারীরা শুধু গৃহস্থালির কাজেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। কৃষিকাজ ছিল পুরুষদের বিষয়। কিন্তু সময় বদলেছে—এখন গ্রামজুড়ে দেখা যায় সারি সারি বস্তায় সবুজ আদার চারা দুলছে বাতাসে। আর সেই বস্তাগুলোর মালিক—গ্রামের নারীরাই।
চান্দোপাড়ার নারীরা বেছে নিয়েছেন ‘বস্তায় আদা চাষ’। নিজেদের উঠানেই সাজিয়েছেন সবুজ বাগান। কেউ ২০০, কেউ ৫০০ বস্তায় আদা চাষ করছেন। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে গ্রামটিতে প্রায় ১২ হাজার বস্তায় আদা চাষ হয়েছে।
তবে এখানেই শেষ নয়। নারীরা এখন চাষ করছেন তেজপাতা, গোলমরিচ ও চুইঝালের মতো মসলাও। অনেকেই বাড়ির পাশে তৈরি করেছেন পুষ্টি বাগান, পেঁয়াজের বীজতলা ও জৈব সার উৎপাদনের ভার্মি কম্পোস্ট ইউনিট।
গ্রামের গৃহিণীরা নিজেরাই গড়ে তুলেছেন সমিতি। তারা প্রতি মাসে সঞ্চয় করছেন, কৃষিযন্ত্র ভাড়ায় দিচ্ছেন, আবার প্রয়োজন হলে স্বল্প সুদে ঋণ নিচ্ছেন। সব লেনদেন হচ্ছে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে—একদম সংগঠিতভাবে।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা খাদিজাতুজ্জোহরা বলেন,
“শুরুতে সামান্য সহায়তা দিয়েছিলাম। এখন নারীরা নিজেরাই সফল উদ্যোক্তা। তাদের আগ্রহ, পরিশ্রম আর ঐক্যই তাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।”
সমিতির সভানেত্রী সাবিনা বেগমের ভাষায়,
“আগে শুধু ঘরের কাজ করতাম। এখন আদা চাষ করে সংসারে বাড়তি আয় হচ্ছে। আমাদের গ্রাম এখন সবার কাছে ‘আদা গ্রাম’। ভবিষ্যতে এটিকে ‘মসলা গ্রাম’ করতে চাই।”
গৃহিণী মরিয়ম বেগম বলেন,
“স্বামীর একার আয়ে সংসার চলত না। এখন আদা চাষে আয় হচ্ছে। ঋণ শোধ করেছি, সংসার ভালোভাবে চলছে।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন,
“শুরুতে মাত্র এক হাজার বস্তায় আদা চাষ হয়েছিল, এখন তা ১২ হাজারে পৌঁছেছে। এই অর্জন নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।”
চান্দোপাড়ার নারীরা এখন শুধু সংসার চালাচ্ছেন না—তারা বাজারে পণ্য বিক্রি করছেন, কৃষিযন্ত্র ভাড়ায় দিচ্ছেন এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
চান্দোপাড়া আজ রাজশাহীর নারীদের আত্মনির্ভরতার প্রতীক। এই গ্রাম দেখিয়ে দিয়েছে—ইচ্ছাশক্তি, ঐক্য আর পরিশ্রম থাকলে গ্রামীণ অর্থনীতিও বদলে দেওয়া সম্ভব।
এই গ্রামের গল্প শুধু আদার নয়—এটি নারী শক্তির, টেকসই কৃষির, এবং নতুন বাংলাদেশের এক অনুপ্রেরণার গল্প।