• হোম > দেশজুড়ে > আন্তর্জাতিক দরপত্রে কক্সবাজারের পরিচালনা দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে

আন্তর্জাতিক দরপত্রে কক্সবাজারের পরিচালনা দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে

  • সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:২১
  • ৩১

---

দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোনো বিলাসবহুল বিমানবন্দর। কাচঘেরা ছয়তলা ভবন, আইকনিক ঢংয়ের ছাদ, ঝকঝকে ফ্লোর আর আধুনিক স্থাপত্যে সাজানো প্রতিটি কোণ—সবই যেন আন্তর্জাতিক মানের প্রতীক। অথচ, বাস্তবে এই স্টেশনে নেই যাত্রীদের ভিড়, নেই সেবার কোলাহল। আলোহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে পড়ে আছে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিকমানের কক্সবাজার রেলস্টেশন—যা আজ কার্যত অচল।

দুই বছর আগে যে স্টেশন উদ্বোধন হয়েছিল কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে, সেটি এখন পরিণত হয়েছে একটি নিস্তব্ধ স্থাপনায়। কোনো দোকান খোলা নেই, চলন্ত সিঁড়ি বন্ধ, ওয়েটিং লাউঞ্জে নেই কোনো যাত্রী, আর যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত টয়লেটও ব্যবহার অনুপযোগী। এমনকি টিকিট কাউন্টারও অচল অবস্থায়।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখন স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—তাদের পক্ষে এই স্টেশনের পরিচালনা সম্ভব নয়। ব্যয়ভার এত বেশি যে, প্রতি মাসে শুধু ইউটিলিটি খাতেই খরচ হবে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। এ কারণে পুরো পরিচালনা বিদেশি কোনো অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়।


স্টেশনটির অবস্থা: অবকাঠামো আছে, কার্যক্রম নেই

২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন। এক মাস পর, অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলাচল শুরু করে ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ ও ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’। কিন্তু আজও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি স্টেশনটি।

ছয়তলা ভবনটির প্রতিটি তলায় রয়েছে বাণিজ্যিক জায়গা, হোটেল, ফুড কোর্ট, অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার ও মাল্টিপারপাস হলের মতো সুবিধা—কিন্তু সেগুলো এখনো শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

সন্ধ্যার পর স্টেশনে গেলে দেখা যায়, বিশাল ভবনের ভেতর কেবল কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী আর কিছু আবর্জনার বিন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্টেশনের সিঁড়িগুলোর সামনে লোহার ব্যারিকেড টানা, আর কোনো কোনো জায়গা বন্ধ করে রাখা হয়েছে ময়লার ঝুড়ি দিয়ে।

একজন স্থানীয় যাত্রী বলেন,

“এত সুন্দর একটা স্টেশন বানানো হলো, কিন্তু কোনো সুবিধা নেই। আলোর ব্যবস্থা নেই, টয়লেট নোংরা, টিকিট কাউন্টারও বন্ধ থাকে। মনে হয় ভূতুড়ে ভবন।”


কোটি কোটি টাকার স্থাপনা, ব্যবহার শূন্য

রেলওয়ের নথি অনুযায়ী, পুরো প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু স্টেশন ভবনের জন্য ব্যয় হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা।
প্রতিটি তলার ব্যবহারযোগ্য স্থান নিম্নরূপ—

  • নিচতলা: টিকিট কাউন্টার, ডাকঘর, এটিএম বুথ, লাগেজ লকার, বিশ্রামাগার, তিনটি দোকান

  • দ্বিতীয় তলা: ১৭টি দোকান, ফুড কোর্ট, ডিপারচার লাউঞ্জ, প্রার্থনা কক্ষ

  • তৃতীয় তলা: দোকান, শোরুম, ফুড কোর্ট, রেস্টুরেন্ট

  • চতুর্থ তলা: ৩৯টি হোটেল রুম, বাণিজ্যিক স্পেস, ডাইনিং এরিয়া

  • পঞ্চম তলা: অফিস স্পেস, মাল্টিপারপাস হল, রেস্টুরেন্ট

  • ষষ্ঠ তলা: সম্পূর্ণ মাল্টিপারপাস ব্যবহারের জন্য

কিন্তু এই তলাগুলোর অধিকাংশই এখন অন্ধকার ও বন্ধ।


বিদেশি হাতে পরিচালনা: আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রস্তুতি

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এই স্টেশনের পরিচালনার জন্য দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর ভরসা করতে পারছে না তারা। কারণ, এমন আন্তর্জাতিকমানের অবকাঠামো পরিচালনায় স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সীমিত।

তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে—বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হবে কক্সবাজার রেলস্টেশনের পরিচালনা।
এই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন,

“আমরা চাই, অভিজ্ঞ বিদেশি প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করুক। দেশীয় প্রতিষ্ঠান চাইলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে অংশ নিতে পারবে। দরপত্রের প্রস্তুতি চলছে, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই আহ্বান করা হবে।”


অদক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে অবচয়

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন,

“উদ্যোগের অভাবে এমন অবচয় হচ্ছে। শত কোটি টাকার স্টেশনের কোনো সুফল মিলছে না। বিনিয়োগের রিটার্ন না আসায় এটি এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর একচেটিয়া নির্ভরতা টেকসই নয়; দেশীয় সক্ষমতাও গড়ে তুলতে হবে।”

অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, এভাবে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো দীর্ঘদিন অচল থাকলে তা জনস্বার্থ ও অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনে।


কক্সবাজারবাসীর প্রত্যাশা

স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে এই স্টেশন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি হতে পারে অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু।
যদি এটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে পর্যটন, বাণিজ্য, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এমনকি স্থানীয় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নতুন অধ্যায় খুলে যেতে পারে।

তবে এখন প্রশ্ন একটাই—
কবে জেগে উঠবে এই ঘুমন্ত স্টেশন?


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/5741 ,   Print Date & Time: Wednesday, 26 November 2025, 04:37:45 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh