রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার—স্বাধীনতার প্রতীক, প্রতিবাদের মঞ্চ। এই মিনারেই টানা সাত দিন ধরে আন্দোলন করছেন দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁরা দাবি তুলেছেন—“বাঁচার মতো বেতন চাই, সম্মানের মতো জীবন চাই।”
শনিবার দুপুরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁরা কালো পতাকা মিছিলের আয়োজন করছেন। তিন দফা দাবিতে এই আন্দোলন ক্রমেই দেশজুড়ে শিক্ষকদের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠছে।
দাবিগুলো হলো—
১️⃣ মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া,
২️⃣ ১,৫০০ টাকা মেডিক্যাল ভাতা,
৩️⃣ এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা।
গত রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁরা অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে দুপুরে তাঁরা স্থানান্তর হন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, যেখানে তাঁরা ঘোষণা দেন—“ন্যায্য দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই মঞ্চ ছাড়ব না।”
গতকাল শুক্রবার ছিল তাঁদের আন্দোলনের ষষ্ঠ দিন। সকাল থেকেই মিনারের পাদদেশে শুরু হয় আমরণ অনশন। হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা—
“শিক্ষক অনাহারে, শিক্ষা অন্ধকারে।”
“আমাদের ন্যায্য দাবিতে সরকারের নীরবতা মানি না।”
এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব দেলোয়ার হোসেন আজিজী বলেন,
“আমাদের দাবি একটাই— ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া দিতে হবে। শিক্ষকরা আর কোনো আশ্বাস শুনতে চান না। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই শহীদ মিনারেই থাকব, অনশন চালিয়ে যাব।”
তিনি জানান, আমরণ অনশনে বসা শিক্ষকদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীরা ঢাকায় এসে যোগ দিচ্ছেন এই আন্দোলনে। এরই মধ্যে দেশের প্রায় সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলছে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
আগামী রবিবার থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরাও নিজ নিজ জেলা থেকে সংহতি কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
এর আগে মঙ্গলবার শিক্ষকরা সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি নিলে পুলিশ তা বাধা দেয়। পরদিন তাঁরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। বৃহস্পতিবারের “মার্চ টু যমুনা” কর্মসূচি আপাতত স্থগিত রাখলেও তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন— “সরকার সাড়া না দিলে পরবর্তী কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বান জানানো হলেও শিক্ষকরা এখনও অনড়। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার জানান,
“অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১ নভেম্বর থেকে ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া (ন্যূনতম দুই হাজার টাকা) দেওয়া সম্ভব। কিন্তু শিক্ষকরা বলেছেন— এখনই ১০ শতাংশ দিতে হবে, পরের বছর আরও ১০ শতাংশ।”
সরকারের এই প্রস্তাব শিক্ষকরা প্রত্যাখ্যান করেছেন, বলছেন— এটি “অপর্যাপ্ত ও অসম্মানজনক।”
অনশনস্থলে থাকা এক শিক্ষিকা বলেন,
“আমরা শিক্ষা দিই, ভবিষ্যৎ গড়ি। কিন্তু আমাদের সন্তানদের চিকিৎসা, ভাড়া, জীবনযাপন—সবকিছুই অনিশ্চিত। আমরা ভিক্ষা চাই না, আমাদের অধিকার চাই।”
রাত গভীরেও মিনারের চারপাশে থেকে যাচ্ছে আন্দোলনরত শিক্ষকদের জটলা। কেউ কেউ মাথার নিচে ব্যাগ রেখে ঘুমিয়ে পড়ছেন, কেউ আবার স্লোগানে ব্যস্ত—
“শিক্ষকের দাবি মানতে হবে, বাঁচতে হলে দিতে হবে।”
এই আন্দোলন আজ শুধু অর্থনৈতিক দাবির নয়, সম্মান ও মর্যাদার আন্দোলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, “আমরা পিছু হটব না— যতক্ষণ না রাষ্ট্র আমাদের কথা শুনছে।”