উত্তরাঞ্চলের তিস্তা তীরবর্তী পাঁচ জেলায় একযোগে মশাল প্রজ্বলনের মাধ্যমে তিস্তা নদী রক্ষার দাবি জানান হাজার হাজার মানুষ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার তিস্তাপাড়ে সমান্তরালভাবে আয়োজিত এই কর্মসূচি ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা মশাল হাতে একযোগে স্লোগান দেন—“জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই”।
তিস্তাপাড়ের মানুষদের বক্তব্য অনুযায়ী, উত্তরের প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল। তারা জানান, বর্ষাকালে ঘন ঘন বন্যা, বন্যার পরে নিয়ন্ত্রণহীন নদীভাঙন, এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির তীব্র সংকট—এই তিন দুর্যোগই তাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। ফলে ফসল, ব্যবহারিক নগরও সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
তিস্তা নদীর ন্যায্য পানিবণ্টন ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে চলতি বছরে আন্দোলনটি বহু কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে ছিল ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারি দুই তীর জুড়ে একযোগে ১১টি পয়েন্টে লাখো মানুষের অবস্থান, ৫ অক্টোবর জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান, এবং ৯ অক্টোবর উপজেলা শহরে গণমিছিল।
আন্দোলন সূত্রে জানানো হয়, রিজওয়ানা হাসানের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী—পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ৬ ফেব্রুয়ারি তিস্তাপাড়ে গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার দ্রুত শুরু করার আশ্বাস দিয়েছেন। পরে জানা গেছে, প্রকল্প কাজ ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু করার ধারণা দেওয়া হয়েছিল।
তবে মাঠে থাকা তিস্তাপাড়ের মানুষরা বলছেন—বছরগুলো গিয়েছে, অগ্রগতির বাস্তব চিত্র মেলেনি। তিস্তা মহাপরিকল্পনার সম্ভাব্য ব্যয় ও সময়সীমা এখনও স্পষ্ট: প্রকল্পটি ১০ বছরের মেয়াদে দুই ধাপে বাস্তবায়িত হবে এবং মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। প্রথম ধাপে প্রথম ৫ বছরে ব্যয় হবে ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা—এর মধ্যে চীন থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৬ হাজার ৭০০ কোটি এবং সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন,
“সরকার যদি নভেম্বরের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু না করে, তবে আমরা তিস্তাপাড়ের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলবো।”
দুলু আরও বলেন, “সরকার ইতিমধ্যে প্রথম ধাপের জন্য ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে—এখন সময় এসেছে কথা নয়, কাজ শুরু করার।”
স্থানীয় কৃষক, মৎস চাষী ও মৎসজীবী সম্প্রদায়ের জন্য তিস্তা নদীর অবস্থা জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন। এক কৃষক বলেন, “বারবার আমার ধানবাগান বন্যায় চলে যায়; আমাদের পরিবার এখন নির্ভর করে সহায়তা আর ভিক্ষার ওপর—কেন আমরা এই উচ্চ দামের প্রতিশ্রুতির মর্যাদা না পাই?”
তিস্তাপাড়ের মানুষেরা জানালেন, যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তারা আগামী নভেম্বর নাগাদ আরও তীব্র এবং কেন্দ্রীয় স্তরের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন—যা শুধুমাত্র স্থানীয় প্রতিবাদ নয়, জাতীয় স্তরে তিস্তা ইস্যুকে উত্তোলন করবে।
উপসংহার ও প্রসঙ্গিকতা
তিস্তা নদী রক্ষা–মহাপরিকল্পনা কেবল একটি অবকাঠামোগত উদ্যোগ নয়; এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষি নিরাপত্তা, ভৌগোলিক স্থিতিশীলতা ও স্থানীয় মানুষের দীর্ঘমেয়াদি জীবনযাত্রার মৌলিক ভিত্তি। প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত না হলে কেবল ভৌত ক্ষতি নয়—সামাজিক অস্থিরতা, জনজীবনের অপর্যাপ্ততা ও প্রতিবন্ধকতাও বাড়বে। স্থানীয় মানুষদের ভয়—বাতিল প্রতিশ্রুতি আর দেরিতেই তাদের জীবনঝুঁকিতে থাকবে।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এখন চাই স্পষ্ট সময়সীমা ও বাস্তব পদক্ষেপ ঘোষণা করা—নইলে তিস্তাপাড়ের মানুষের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন আর তীব্র হবে বলেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।