ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় তিন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় ভারতীয় বাসিন্দারা গরু পাচারের সন্দেহে তাদের ওপর হামলা চালায়। বিজিবি জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ–এর সঙ্গে যোগাযোগ চলছে এবং ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে।
নিহতদের পরিচয়
নিহত ব্যক্তিরা হলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার তিন যুবক—
১️আলীনগর গ্রামের আশ্বব আলীর ছেলে জুয়েল মিয়া (৩২),
২️বাসুল্লা গ্রামের কনা মিয়ার ছেলে পতি মিয়া (৪৫),
৩️কবিলাশপুর গ্রামের কদ্দুস মিয়ার ছেলে সজল মিয়া (২০)।
তিনজনই কয়েক দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন বলে তাঁদের পরিবার জানিয়েছে। পরে বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসন থেকে খবর পেয়ে তারা জানতে পারেন, ভারতীয় সীমান্তের ওপারে তাঁদের লাশ পাওয়া গেছে।
বিজিবির অবস্থান
৫৫ বিজিবির (হবিগঞ্জ ব্যাটালিয়ন) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তানজিলুর রহমান আজ বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, “গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্তবর্তী বিদ্যাবিল এলাকা দিয়ে ওই তিনজন বাংলাদেশি দুই-তিন দিন আগে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। তারা সীমান্ত থেকে প্রায় চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে ত্রিপুরা রাজ্যের কারেঙ্গিছড়া এলাকায় অবস্থান করছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তারা গরু আনার উদ্দেশ্যে ভারতে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভারতীয়রা গরু চোর সন্দেহে সংঘবদ্ধভাবে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু হয়।”
যোগাযোগ ও যাচাই প্রক্রিয়া
বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে এবং ঘটনার সঠিক কারণ যাচাই করা হচ্ছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজিলুর রহমান বলেন, “আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করছি। সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে উভয় পক্ষ কাজ করছে। পাশাপাশি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, লাশ ফেরত আনার প্রক্রিয়া নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে।
স্থানীয়দের বক্তব্য
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য তারেকুর রহমান বলেন,
“রাতে বিজিবি নিহতদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে ভারতে পাঠিয়েছে। সেখানে পাওয়া মরদেহের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে যে তারা জুয়েল, পতি ও সজল।”
তিনি আরও জানান, নিহতদের পরিবার শোকাহত অবস্থায় আছে এবং লাশ দ্রুত ফেরত চেয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ: সীমান্তে অনিশ্চিত জীবন
এই ঘটনার পর সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায়, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাবই অনেক সময় মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ঠেলে দেয়।
চুনারুঘাটের এক বাসিন্দা বলেন, “জীবিকার তাগিদে মানুষ ঝুঁকি নেয়। কিন্তু সীমান্তে জীবন এত সস্তা হয়ে গেছে যে, এক পা ভুল হলেই প্রাণ যেতে পারে।”
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সীমান্তে গরু পাচার বন্ধে উভয় দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক বিকল্প তৈরি করাও জরুরি।
বিশ্লেষণ: নিরাপত্তার পাশাপাশি মানবিকতার প্রশ্ন
বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তে এ ধরনের সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, মানবিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সমাধান খুঁজতে হবে।
তারা বলেন, সীমান্তে কর্মসংস্থানের অভাব, দারিদ্র্য ও সীমিত সুযোগ মানুষকে অবৈধ পথে যেতে বাধ্য করে। এই বাস্তবতা মোকাবিলায় দুই দেশের যৌথ উদ্যোগই হতে পারে স্থায়ী সমাধান।