• হোম > অর্থনীতি > ক্ষুদ্রঋণে নতুন নিয়ন্ত্রণ: স্বাধীনতা না পরাধীণতা?

ক্ষুদ্রঋণে নতুন নিয়ন্ত্রণ: স্বাধীনতা না পরাধীণতা?

  • মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১১
  • ৫৪

---

বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত—যে খাত একসময় দরিদ্র মানুষের পুনর্জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন সেটির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।
ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএস, বুরো বাংলাদেশ, উদ্দীপনাসহ দেশের বড় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথমবারের মতো ‘স্বতন্ত্র পরিচালক’ নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আসছে।


সরকার বলছে—“শৃঙ্খলা আনতে হবে”

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) জানিয়েছে, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী মাঝারি ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখতে হবে।

এমআরএর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন,

“ক্ষুদ্রঋণ খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরিবারতন্ত্র দূর করা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।”

তিনি আরও বলেন, “স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোই করবে, এমআরএ কেবল নিয়ম ঠিক করবে।”


এনজিও খাতের উদ্বেগ: “এটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত”

অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টিকে দেখছে ‘সরকারি হস্তক্ষেপের সূচনা’ হিসেবে।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন,

“এটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ যে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হবে না, তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব? ব্যাংক খাতের ইতিহাসই বলছে, এমন পদক্ষেপ দুর্নীতি কমায় না, বরং বাড়ায়।”


সিডিএফের আপত্তি: “ক্ষতিকর, বেআইনি ও অপ্রয়োজনীয়”

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর একমাত্র নেটওয়ার্ক ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিডিএফ) উদ্যোগটিকে আখ্যা দিয়েছে
“ক্ষতিকর, বেআইনি ও অপ্রয়োজনীয়” বলে।
৬ অক্টোবর সিডিএফ অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ–এর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

সিডিএফের চেয়ারম্যান মুরশেদ আলম সরকার বলেন,

“আইনের শিকল নয়, দরকার উদ্যমী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়ালে সামাজিক উদ্যোগের প্রাণশক্তি নষ্ট হবে।”


হোসেন জিল্লুর রহমান: “বাস্তবতা অনুধাবন ছাড়াই প্রস্তাব”

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন,

“বাস্তবতা অনুধাবন ছাড়াই এ ধরনের প্রস্তাব আনা হচ্ছে। এতে ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহজাত পরিবেশ নষ্ট হবে এবং সরকারি হস্তক্ষেপ প্রকট হবে।”

তিনি বলেন, ক্ষুদ্রঋণ হলো মানবিক উন্নয়নের হাতিয়ার, এটিকে প্রশাসনিক যন্ত্রে পরিণত করা মানে এর আত্মাকে হত্যা করা।


টিআইবি’র সতর্কতা: “রাজনৈতিক প্রভাবের ঝুঁকি”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)–এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,

“ক্ষুদ্রঋণ খাতের স্বকীয়তা নষ্ট করা যাবে না, কিন্তু সুশাসনও দরকার। ব্যাংক খাতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ ব্যর্থ হয়েছে—সেই মডেল ক্ষুদ্রঋণে কার্যকর হবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।”

তিনি আরও সতর্ক করেন,

“এ পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”


কারা হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক?

খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হলে—

  • সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরির ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে,

  • বয়স হতে হবে ৩৫ থেকে ৭০ বছর,

  • একাধিক প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে পরিচালক হওয়া যাবে না,

  • পরিবারের কোনো সদস্য একই পর্ষদে থাকতে পারবেন না।

তবে ক্ষুদ্রঋণ খাতের সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা—
এই যোগ্যতা শর্তের মাধ্যমে মূলত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন করা হবে, যা “স্বাধীন এনজিও সংস্কৃতির জন্য অশনিসংকেত”।


সিইও নিয়োগেও নতুন শর্ত

প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগেও আসছে কড়াকড়ি।

  • সিইও হতে হলে কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা এবং

  • ৫ বছর ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

  • বয়স ৪০ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে হতে হবে।

  • সিইও নিয়োগের পর এমআরএর অনাপত্তিপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক।

এ বিষয়ে সিডিএফ বলছে, “এটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারি অনুমোদন নির্ভরতা বাড়াবে এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ করবে।”


সংখ্যায় ক্ষুদ্রঋণ খাত

২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এমআরএর হিসাব অনুযায়ী:

  • নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান: ৭২৪টি,

  • মোট গ্রাহক: ৪ কোটি ১৫ লাখ,

  • মোট ঋণ বিতরণ: ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা,

  • কর্মরত জনবল: ২ লাখ ২৩ হাজার।

এই খাতে ঋণ খেলাপির হার মাত্র ২ শতাংশেরও কম, যা বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সবচেয়ে স্থিতিশীল হিসেবে বিবেচিত।


বিশ্লেষণ: “নিয়ন্ত্রণ না আস্থা?”

অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, ব্যাংকের মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো মালিকানাভিত্তিক নয়, বরং সমাজভিত্তিক। তাই একে ব্যাংক খাতের মতো করে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস খাতের চরিত্র বদলে দিতে পারে।

তাদের মতে, ক্ষুদ্রঋণ খাতে অনিয়ম থাকলে তার সমাধান হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি,
কিন্তু রাজনৈতিক নিয়োগ বা প্রশাসনিক প্রভাব নয়।


মানবিক বাস্তবতা

ক্ষুদ্রঋণ শুধু অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়, এটি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি ও মর্যাদার লড়াই।
যদি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভরশীল, আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক হয়ে পড়ে, তবে তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে সেই নারী উদ্যোক্তার,
যিনি ২০ বছর ধরে ব্র্যাক বা আশার কাছ থেকে ছোট ঋণ নিয়ে আজ নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন।


উপসংহার

ক্ষুদ্রঋণ খাত বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের মেরুদণ্ড।
এটি “সামাজিক ব্যবসা”—যেখানে লাভ নয়, মানবিক প্রভাবই আসল সাফল্য।
তাই নিয়ন্ত্রণের নামে যদি স্বাধীনতার পরিসর সংকুচিত হয়, তবে খাতটি হারাবে তার মানবিক আত্মা।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/5532 ,   Print Date & Time: Wednesday, 26 November 2025, 04:26:53 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh