• হোম > বাংলাদেশ > রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বোঝা

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বোঝা

  • বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৬
  • ২৮

---

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে এক সময় যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, আজ সেগুলোর অনেকই সরকারের কাঁধে ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে বর্তমানে ২৩২টি স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৯২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা, এবং তাদের জনবল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু এই বিপুল সম্পদ ও কর্মীবাহিনীও অর্থনীতিতে লাভের বদলে ক্ষতির রেখা টেনেছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত নিট লোকসান হয়েছে ৫ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারকে তাদের অনুদান হিসেবে দিতে হয়েছে ৫০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়— এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের বোঝাও ক্রমেই বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫২১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকাই অনাদায়ী ঋণ।


দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও ধারাবাহিক লোকসান

অর্থ বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানই ধারাবাহিক লোকসান গুনছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বিআরটিসি, বিএফডিসি, বিএসএফআইসি ও বিজেএমসি— ১৭ বছর ধরে একটানা লোকসানে রয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্প খাতের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নিট লোকসান ছিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, সেবা খাতের ছয় প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা, বাণিজ্যিক খাতের তিন প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা, এবং অন্যান্য খাতের ১৭ প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৩২১ কোটি টাকা।

লোকসানের দিক থেকে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) — এক অর্থবছরেই লোকসান ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। তার পরেই টিসিবি (৩ হাজার ৩০ কোটি), বিসিআইসি (১ হাজার ৫০৯ কোটি), বিএসএফআইসি (৫৭১ কোটি) ও বিজেএমসি (২২৬ কোটি টাকা)।


সংস্কারহীনতা ও সরকারি নীরবতা

অন্তর্বর্তী সরকার নানা কাঠামোগত সংস্কার উদ্যোগ নিলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সংস্কার তালিকার বাইরে।
প্রতি বছর সরকারি বাজেট থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে ব্যয় হয় হাজার হাজার কোটি টাকা, অথচ আয়-ব্যয় বিশ্লেষণে সেগুলোর কর্মদক্ষতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই এখন “অকার্যকর আমলাতান্ত্রিক বলয়ে” আটকে পড়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, রাজনৈতিক প্রভাব, যোগ্যতা না থাকা ব্যক্তিদের নিয়োগ এবং জবাবদিহির অভাবে এগুলো দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়ছে।


বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে করণীয়

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন—

“রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক চিত্র সরকারের কোষাগারের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে। কিছু প্রতিষ্ঠান করপোরাটাইজড করেও ফল পাওয়া যায়নি। সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে— বিশেষত আর্থিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত থেকে।”

অন্যদিকে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন—

“রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান অদক্ষ জনবলের কারণে বছরের পর বছর লোকসানে চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে, আর যেগুলো জরুরি, সেগুলোকে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে।”


অপচয়, অনৈতিক বোনাস ও জবাবদিহির ঘাটতি

অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোকসান সত্ত্বেও বহু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের অনৈতিকভাবে বোনাস দিয়ে যাচ্ছে।
অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে না, এমনকি আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) অর্থনৈতিক সমীক্ষায় লোকসানি দেখালেও নিজস্ব প্রতিবেদনে দেখিয়েছে মুনাফা।
এই গরমিল শুধু স্বচ্ছতার অভাবই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়েরও দৃষ্টান্ত।


টেলিটক ও বিমান— সম্ভাবনার অপচয়

যেখানে বেসরকারি মোবাইল অপারেটররা লাভ করছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড টানা লোকসানে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের ক্ষতি ১৮০ কোটি টাকা।

একইভাবে, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও সর্বোচ্চ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারেনি।
যান্ত্রিক ত্রুটি, উচ্চ ভাড়া, দুর্বল পরিষেবা, ও দেরি ফ্লাইটের জন্য প্রতিষ্ঠানটি সমালোচিত। বর্তমানে এর দায়দেনা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।


মুনাফায় থাকা কিছু প্রতিষ্ঠান

সব প্রতিষ্ঠানই যে লোকসানে, তা নয়। মুনাফার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ), বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) ও সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিটিআরসি ৪,৩২৮ কোটি, বিপিসি ৩,৯৪৩ কোটি, সিপিএ ২,০৪৩ কোটি, সিএএবি ১,৯৪৮ কোটি ও বিবিএ ৫৪৭ কোটি টাকার মুনাফা করেছে।


অর্থ বিভাগের নিজস্ব মূল্যায়ন

অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেল ১০১টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে—
৭৯টি প্রতিষ্ঠান মাঝারি থেকে অতি উচ্চমাত্রার আর্থিক ঝুঁকিতে রয়েছে।
এর মধ্যে ১৪টি “অতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ”, ২৮টি “উচ্চ ঝুঁকি”, এবং ৩৭টি “মাঝারি ঝুঁকিতে”।
এই চিত্রই প্রমাণ করে, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া ভবিষ্যতে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আরও গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে।


বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ পথ

অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন—

“এটি কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ চিত্র। তবে রাজনৈতিক সাহস ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কার সম্ভব নয়। একে আংশিক নয়, সার্বিকভাবে সংস্কার করতে হবে।”

অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের উচিত হবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ খাত ছাড়া বাকি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা।
যেগুলোর সংস্কার সম্ভব নয়, সেগুলো বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ করা।


উপসংহার

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসান কেবল অর্থনীতির সমস্যা নয়— এটি প্রশাসনিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রতিফলন।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি অন্তত সংস্কার প্রক্রিয়ার রূপরেখা তৈরি করে যেতে পারে, তবে ভবিষ্যৎ সরকার সেই ভিত্তিতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারবে।
কারণ রাষ্ট্রের সম্পদকে টেকসই অর্থনীতির পথে ফিরিয়ে আনা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হবে না।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/5378 ,   Print Date & Time: Friday, 10 October 2025, 11:35:45 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh