বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস সৌদি আরব। অথচ সেখান থেকেই প্রবাসীরা আয় পাঠাতে সবচেয়ে বেশি খরচ দিচ্ছেন—৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত।
এ বিষয়টি ‘চিন্তার কারণ’ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন,
“এই খরচ প্রবাসী কর্মীদের জন্য বড় চাপ। যদি দুই দেশের আর্থিক খাত যৌথভাবে কাজ করে, তাহলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এতে প্রবাসী, ব্যাংকিং খাত এবং দুই দেশের অর্থনীতি—সবাই উপকৃত হবে।”
‘সৌদি আরব–বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৫’: অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত
গতকাল রাজধানীর এক পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় ‘সৌদি আরব–বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৫’–এর দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন ‘বিজনেস সামিট অ্যান্ড কোলাবরেশন’।
অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল সৌদি আরব–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এসএবিসিসিআই)।
তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সৌদি আরব থেকে আগত ২০ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়, নেতৃত্ব দেন মাজেদ আল উমরান গ্রুপের কর্ণধার শেখ ওমর আব্দুল হাফিজ আমির বকশ।
দলে ছিলেন স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, আবাসন ও উৎপাদন খাতের বিনিয়োগকারী ও বিশেষজ্ঞরা।
“বাংলাদেশ–সৌদি সম্পর্ক অর্থনৈতিকভাবে গভীর হতে হবে”
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন,
“সৌদি আরবের দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বিপুল, যা বাংলাদেশ বহু বছর ধরে সরবরাহ করছে।
বাংলাদেশও সৌদি বাজারে পোশাক, কৃষিপণ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানির সুযোগ বাড়াতে পারে।
আমাদের জ্বালানি ও বিনিয়োগ দরকার, সৌদি আরবের আছে সক্ষমতা; একসঙ্গে কাজ করলে উভয়েরই লাভ।”
তিনি আরও বলেন,
“বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার, দ্রুতই ট্রিলিয়ন ডলারের দিকে যাচ্ছে।
ইসলামী বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ কেন্দ্রে পরিণত হবে।”
রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক বন্ধনের ওপর অর্থনৈতিক সহযোগিতা
গভর্নর মনসুর স্বীকার করেন—
যদিও সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বন্ধন গভীর, তবুও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় ঘাটতি রয়েছে।
“বাণিজ্য, অর্থনীতি, আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ও শ্রমবাজার—সব ক্ষেত্রেই উন্নতির জায়গা আছে।
কিছু সমস্যা থাকলেও এগুলো সমাধান করা সম্ভব, যদি পারস্পরিক আস্থা ও অংশীদারিত্ব তৈরি হয়।”
বিএনপি নেতার আহ্বান: “জিয়ার শুরু করা রেমিট্যান্স যাত্রা এগিয়ে নিতে হবে”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন,
“মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
তাঁর উদ্যোগেই প্রবাসী শ্রমবাজার গড়ে ওঠে। আজকের রেমিট্যান্স সাফল্যের মূলেও সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত রয়েছে।”
তিনি যোগ করেন,
“দক্ষতা উন্নয়ন ও আধুনিক প্রশিক্ষণ দিলে রেমিট্যান্স আয় বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব।
সৌদি বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে প্রবাহিত হলে বাংলাদেশ ফ্রন্টিয়ার থেকে ইমার্জিং মার্কেটে উন্নীত হতে পারে।”
ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের নতুন কাঠামো
এসএবিসিসিআই সভাপতি আশরাফুল হক চৌধুরী জানান—
বাংলাদেশ–সৌদি আরব যৌথ ব্যবসায়ী চেম্বার গঠনের মাধ্যমে ৫৩ বছরের ঘাটতি পূরণ হয়েছে।
তিনি বলেন,
“সৌদি আরব আমাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু।
এখন লক্ষ্য—দুই দেশের মধ্যে পোশাক, কৃষি, আইটি, স্বাস্থ্য ও দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি বাড়ানো এবং সৌদি বিনিয়োগ টানা।”
বিনিয়োগে সুযোগ, চ্যালেঞ্জও কম নয়
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন—
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াতে হলে ব্যাংকিং লেনদেন সহজ করা, বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি জোরদার করা ও প্রবাসী আয়ে ট্রান্সফার খরচ কমানো এখন জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী,
২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে প্রবাসী আয় বেড়ে ২ হাজার ৩৭০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এর ৪১ শতাংশ এসেছে সৌদি আরব থেকে।
কিন্তু একই সময়ে হুন্ডি ও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলেও উল্লেখযোগ্য অর্থ প্রবাহিত হচ্ছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ: পরিশ্রমী প্রবাসীর ঘামে ভেজা অর্থ
রিয়াদ, জেদ্দা কিংবা দাম্মামের হাজারো বাংলাদেশি শ্রমিক প্রতিদিন ১২–১৪ ঘণ্টা কাজ করেন—
তাদের পাঠানো অর্থেই দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে।
কিন্তু সেই অর্থ পাঠাতে যদি ৬–১০% পর্যন্ত খরচ দিতে হয়, তাহলে তাদের কষ্টের প্রতিফল কমে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, এটি এক মানবিক শক্তি—যার মূল্য শুধু টাকায় মাপা যায় না।
প্রবাসীদের জন্য ন্যায্য আর্থিক পরিবেশ তৈরি করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হবে।
উপসংহার
সৌদি–বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলন শুধু বাণিজ্য নয়, বরং দুই দেশের পারস্পরিক বিশ্বাসের নতুন সূচনা।
প্রবাসী আয়ের ব্যয় কমানো, বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানো এবং আর্থিক সহযোগিতা জোরদার করা গেলে
বাংলাদেশ হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার।