বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়েছে।
২০২৪ সালের তুলনায় ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালে তা দাঁড়াবে ২১.২ শতাংশে—বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই উদ্বেগজনক চিত্র।
এটি কভিড-পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার, যা দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নতুন প্রশ্ন তুলেছে—“প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু কার জন্য?”
কর্মসংস্থানে ধস, নারীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬০.৯ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৫৮.৯ শতাংশে।
অর্থাৎ, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, যার মধ্যে ২৪ লাখই নারী।
ফলে কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত কমে ৫৬.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এটি প্রমাণ করে যে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চাকরি সৃষ্টি করতে পারছে না—বরং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
দারিদ্র্যের ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতা
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে—
-
২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭%
-
২০২৩ সালে ১৯.২%
-
২০২৪ সালে ২০.৫%,
এবং এখন (২০২৫ সালে) তা ২১.২%।
এটি গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তবে সংস্থাটি আশা দেখিয়েছে—
যদি সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন হয়, ২০২৬ সালে দারিদ্র্য ১৯.১% এবং ২০২৭ সালে ১৮.১%–এ নেমে আসতে পারে।
কেন বাড়ছে দারিদ্র্য
বিশ্বব্যাংক বলছে—
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত মজুরি হ্রাস এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
“ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বল্প বেতনের শ্রমজীবী শ্রেণি।
২০২৫ অর্থবছরে প্রকৃত মজুরি কমেছে ২ শতাংশ।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া: “দারিদ্র্য আছে, কিন্তু বিশ্লেষণ দরকার”
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন,
“দারিদ্র্য বেড়েছে—এটা বলার আগে জানতে হবে, কীভাবে তারা তা মেপেছে।
অমর্ত্য সেনও বলেছিলেন—‘দারিদ্র্য চেনা যায় মানুষের চেহারায়, পরিসংখ্যানে নয়।’”
তবে তিনি স্বীকার করেন, দেশে অর্থনৈতিক চাপ ও কর্মসংস্থান সংকট “বাস্তব সমস্যা”।
স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন চিত্র
বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আগেই দারিদ্র্য বৃদ্ধির তথ্য দিয়েছিল।
-
বিবিএস (২০২৫): দারিদ্র্য ১৯.২%
-
পিপিআরসি: দারিদ্র্য ২৭.৯৩%,
অতিদারিদ্র্য ৯.৩৫% (২০২২ সালে ছিল ৫.৬%)
এই দুই সংস্থার হিসাব ও বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে পার্থক্য থাকলেও প্রবণতা এক—
দারিদ্র্য বাড়ছে, এবং নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা অবনতি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি:
“বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে আয়-ব্যয়ের ফাঁদে ফেলেছে।
এখন অনেক ব্যবসা ছোট হয়ে গেছে, নতুন চাকরি সৃষ্টি বন্ধ।”
ড. সাদিক আহমেদ, সহসভাপতি, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই):
“দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে হলে কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
ড. ফ্রানজিস্কা ওনসর্জ, প্রধান অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক (দক্ষিণ এশিয়া):
“কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্মুক্ত বাণিজ্য বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত খুলতে পারে।
নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতে সম্পদ প্রবাহ বাড়াতে হবে।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সাফল্য নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর—
-
সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়ন,
-
ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতা,
-
দেশীয় ও বৈদেশিক অর্থনৈতিক পরিবেশের অনুকূলতা।
এগুলো সফল হলে ২০২৭ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং দারিদ্র্য কমবে।
তবে সংস্থাটি সতর্ক করেছে—এই পুনরুদ্ধার “অত্যন্ত নাজুক” হবে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ
অর্থনীতির এই শুষ্ক সংখ্যার পেছনে আছে কোটি মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই।
রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত এখন সাধারণ মানুষের মুখে একই প্রশ্ন—
“আমাদের আয় বাড়ছে না, দাম কমছে কবে?”
হকার, গার্মেন্টস শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী—সবার কথাতেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জীবিকার অনিশ্চয়তা।
অর্থনীতি যে কেবল প্রবৃদ্ধির নয়, মানুষের মঙ্গলেও টিকে থাকতে হবে—এ বার্তাই দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের এই সতর্কবার্তা।