জারেড কুশনার — নাম এলে স্বভাবতই ‘জামাই’ পরিচয়টা সামনে আসে। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি রিয়েল এস্টেট ব্যবসার পরিমাণটা পেয়েছেন; রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক জ্ঞানে অবশ্য তিনি অপরিণত। তবু তাকে অবহেলা করার ভুল করা ঠিক হবে না—কারণ তার কাজেই লুকিয়ে আছে এক গভীর বিপদ।
কুশনারের মধ্যপ্রাচ্য নীতি—বিশেষত ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বের প্রতি তার ভূমিকা—র্যান্ডম কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের প্রতিচ্ছবি, যেখানে অনির্বাচিত শক্তিশালী ব্যক্তিদের সুবিধে করে দিয়ে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দখলকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। কুশনার আসলে একক কোনো নায়ক নয়; তিনি এমন এক ব্যবস্থার মুখপাত্র, যেখানে বহুজাতিক কর্পোরেট ও রাষ্ট্রশক্তি মিলে জমি কেড়ে নেয়া, জনসাধারণকে দমন ও এলাকার ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন করে।
তার পরিচিত নকশাগুলোর মধ্যে ‘শতাব্দীর চুক্তি’ অন্যতম—যে পরিকল্পনায় গাজার কিছু অংশকে সংস্কারের আড়ালে ‘ভূমধ্যসাগরীয় রিভিয়েরা’ বানিয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে। প্রথম নজরে এটাকে দুর্বল অঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রস্তাব মনে হলেও বাস্তবে এটি ফিলিস্তিনি জমি ও অধিকার হরণের কৌশল। মূলত সাধারণ মানুষকে শ্রমিক করা হবে, আর লাভ কুড়াবে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও সরকার। এটা ডেভিড হার্ভের বর্ণিত ‘সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া ও পুঁজি তৈরি’ মডেলের আধুনিক রূপ।
এ ধরনের প্রকল্পগুলোই আধুনিক উপনিবেশিকতার নতুন গান—পবিত্র শহর থেকে শরণার্থী শিবির পর্যন্ত সবকিছুকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখা। কুশনারের ‘শান্তি’ দাবি অনুশীলনে আরব প্রতিরোধের শক্তিকে দুর্বল করে, ফিলিস্তিনকে বহুস্তরে উপেক্ষিত করে ইসরায়েলি দখলকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা মাত্র। এতে আরব লীগের ঐতিহ্যবাহী একতাও দুর্বল হয়।
কুশনার ও তার দল শুধু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়নি; তারা মানচিত্রও বদলানোর চেষ্টা করেছে — জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর, গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দান ইত্যাদি—সবই ফিলিস্তিনি অস্তিত্ব মুছে ফেলার একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। আইন ও কৌশল ব্যবহার করে জমির অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, এবং এটি অঞ্চলজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে।
এই নীতির মূলে আছে একটি আর্থ-রাজনৈতিক কৌশল: অভিজাত আরব শাসক এবং পশ্চিমা মূলধনকে যুক্ত করে স্থানীয় জনগণকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা—ফলে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় সম্পদ ‘হস্তান্তর’ হয়ে যায়। তবে এই চুক্তিগুলো অনেক দুর্বল; কারণ উপরের থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সবসময় নিচের স্তরের জনগণের গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
আরব তরুণ প্রজন্ম, যারা গাজা ও জেরুজালেমের ধ্বংস দেখে বড় হয়েছে, তারা এই গল্পে বিশ্বাস করে না। গতকালের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের মতো করে, নতুন প্রজন্মও অন্যরকম রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে—যা সময়ের সঙ্গে বৃহৎ পরিবর্তন আনতে পারে।
সবশেষে বলা যায়—কুশনারের প্রকল্পগুলো জমি, তেল বা শরীরি সম্পদের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো একটি কর্পোরেট-উপনিবেশবাদী সভ্যতার রূপরেখা তৈরির চেষ্টা, যেখানে মানুষের ইতিহাস, অধিকার ও আত্মপরিচয় বাণিজ্যের কাছে বিক্রি করা হয়। শান্তির আড়ালেের এই রাজকীয় প্রলোভন একদিন ধস খাবে — কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার আগে হাজারো নিরীহ মানুষের ক্ষতই কায়েম থাকবে।