জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন এক অধ্যায়ে পৌঁছেছে—দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন ইন্টারপোলের রেড নোটিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদসহ মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশের আবেদন করা হলেও, জারি হয়েছে মাত্র চারটি।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইন্টারপোলের নিজস্ব আইনগত কাঠামো ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রটোকলের কারণে আবেদন করলেই নোটিশ জারি হয় না। সংস্থাটি প্রতিটি আবেদনের বৈধতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মানবাধিকার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে।
চারজনের রেড নোটিশ, দেশে ফিরেছেন মাত্র একজন
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারপোল এখন পর্যন্ত শুধু সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, আরিফ সরকার, মহসিন মিয়া ও আওলাদ হোসেনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে।
তবে এদের মধ্যে মাত্র একজনকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
বাকি ২৪ জনের বিষয়ে ইন্টারপোল এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
সূত্রমতে, বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং সরকারি দপ্তরের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি।
এনসিবির আবেদন ও আন্তর্জাতিক জটিলতা
বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) তিন ধাপে এসব আবেদন পাঠায়।
কিন্তু ইন্টারপোলের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক সংঘাত-সংক্রান্ত মামলায় সরাসরি রেড নোটিশ জারি করা যায় না, যদি সেটি রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা ক্ষমতাসংক্রান্ত হয় বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) শাহাদাত হোসাইন বলেন,
“ভিন্ন দেশে অবস্থানরত আসামিদের ধরতে ইন্টারপোলে আবেদন করা হয়। তবে সংস্থাটির কিছু নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়া আছে—সব আবেদনেই রেড অ্যালার্ট হয় না।”
আইনগত দৃষ্টিকোণ: বন্দী বিনিময় চুক্তির সীমাবদ্ধতা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাইফুল হক সাইফ বলেন,
“যে দেশের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই, সেই দেশ থেকে কাউকে ফেরানো প্রায় অসম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, অনেক দেশই রাজনৈতিক কারণে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের আশ্রয় দেয়, বিশেষ করে যখন অভিযোগগুলো মানবাধিকার বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জটিল হয়ে পড়ে।
ইন্টারপোলের নোটিশে বাংলাদেশ
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে বর্তমানে বিশ্বের ৬,৫১৭ জন ওয়ান্টেড ব্যক্তির নাম রয়েছে।
এর মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক ৬০ জন।
ইন্টারপোলের মতে, রেড নোটিশ কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নয়, বরং এটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে জানিয়ে দেয় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে আটক রাখার অনুরোধ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার মানবিক অভিঘাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেড নোটিশ ইস্যু করা কেবল আইনি বা রাজনৈতিক ইস্যু নয়; এটি মানবিক দিক থেকেও প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশত্যাগী ব্যক্তিদের পরিবার, কর্মচারী ও সহযোগীরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, যেকোনো আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ব্যক্তির মানবিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশ্লেষণ: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান
বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ইন্টারপোল ও জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের নোটিশ ও আবেদন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাপকাঠিতেও প্রভাব ফেলে।
যদি এসব মামলার তদন্ত ও বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন না হয়, তবে আন্তর্জাতিক আস্থার সংকট আরও গভীর হতে পারে।