গাজার অবরুদ্ধ জনগণের জন্য ত্রাণ বহন করতে গিয়ে যে নৌবহর মানবতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, সেটিই আজ নির্যাতনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক হওয়া আন্তর্জাতিক অধিকারকর্মীরা ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন।
তাঁরা জানান, বন্দিদশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে থাকতে হয়েছে, বেঁধে রাখা হয়েছে, পানির অভাবে শৌচাগারের পানি পান করে বেঁচে ছিলেন—এমন বাস্তবতার বিবরণ শুনে কেঁপে উঠছে বিশ্বমানবতা।
ত্রাণযাত্রা থেকে আটক অভিযান
এই নৌবহরটি গাজার ওপর আরোপিত ইসরায়েলি নৌ অবরোধ ভাঙার প্রতীকী প্রচেষ্টা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল।
লক্ষ্য ছিল, অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের কাছে সামান্য ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া—কিন্তু তা থামিয়ে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী।
গত বুধবার থেকে শুক্রবারের মধ্যে প্রায় ৪৫০ জনকে আটক করা হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা, এবং কয়েকজন ইউরোপীয় সংসদ সদস্য।
“আমাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করেছে”—ফেরত আসা কর্মীদের বর্ণনা
রোমে ফিরে ইতালীয় অধিকারকর্মী চেজারে তোফানি সাংবাদিকদের বলেন,
“আমাদের সঙ্গে ভয়ংকর আচরণ করা হয়েছে। পুলিশ ও সেনারা একে অপরের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের নিয়ে খেলেছে।”
ইতালির ইসলামিক কমিউনিটিজ ইউনিয়নের সভাপতি ইয়াসিন লাফরাম বলেন,
“তারা আমাদের ওপর অস্ত্র তাক করে রাখে, অপমান করে। গণতন্ত্রের দাবিদার যে রাষ্ট্র, সেখানে এমন বর্বরতা অকল্পনীয়।”
অন্য সাংবাদিক সাভেরিও তোমাসি আরও একধাপ এগিয়ে বলেন,
“আমাদের সঙ্গে বানরের মতো আচরণ করা হয়েছে। ওষুধ দেয়নি, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে, কুকুর লেলিয়ে ভয় দেখিয়েছে।”
“শৌচাগারের পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম” — মালয়েশীয় শিল্পীদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
মালয়েশিয়ার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও গায়িকা হেলিজা হেলমি ও তাঁর বোন হাজওয়ানি হেলমি ইস্তাম্বুলে পৌঁছে বলেন,
“তারা আমাদের না খাইয়ে রেখেছে। তিন দিন কোনো খাবার পাইনি। আমরা বেঁচে ছিলাম শুধু টয়লেটের পানি খেয়ে।”
হাজওয়ানি বলেন,
“আমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তারা বলল—‘তারা মরে গেছে কিনা, সেটা আমাদের বিষয় নয়।’ এমন নিষ্ঠুর মানুষ আমরা জীবনে দেখিনি।”
“মাথা তুলে তাকাতে দেওয়া হয়নি” — ইতালীয় সাংবাদিক লরেনজো ডি’আগোস্তিনোর বিবৃতি
ডি’আগোস্তিনো অভিযোগ করেন,
“আমার টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র চুরি করেছে। যখনই মাথা তুলেছি, তারা পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে, থাপ্পড় মেরেছে।”
তিনি বলেন, বন্দীদের লেজার লাইট ও বন্দুক তাক করে ভয় দেখানো হয়েছে, কুকুর লেলিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে।
গ্রেটা থুনবার্গকে টেনে হিঁচড়ে নেওয়ার অভিযোগ
ফেরত আসা কয়েকজন কর্মী জানিয়েছেন, গ্রেটা থুনবার্গকেও নির্যাতন করা হয়েছে।
তাঁদের ভাষায়—
“গ্রেটাকে মাটিতে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া হয়, ইসরায়েলি পতাকায় চুমু খেতে বাধ্য করা হয়, এবং প্রচারণার কাজে তাঁর ছবি ব্যবহার করা হয়।”
ইসরায়েলি সরকারের সাংঘর্ষিক প্রতিক্রিয়া
এই অভিযোগের পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে,
“সব অভিযোগ মিথ্যা। বন্দীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আচরণ করা হয়েছে।”
তবে চরম ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ভিন্ন সুরে বলেন,
“আমি গর্বিত যে আমরা ফ্লোটিলা কর্মীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করেছি। যারা সন্ত্রাসের পক্ষ নেয়, তারা সন্ত্রাসীই।”
এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র নিন্দার জন্ম দিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
পাকিস্তান, তুরস্ক, কলম্বিয়া, গ্রিসসহ বহু দেশ ইসরায়েলি আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছে।
গ্রিস লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ চলছে।
ইস্তাম্বুল, রোম, বার্সেলোনা ও প্যারিসে মানুষ রাস্তায় নেমে “Free the Flotilla Activists” প্ল্যাকার্ড হাতে মানবতার পক্ষে আওয়াজ তুলছে।
এক টুকরো মানবতার আহ্বান
এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে—
“ত্রাণযাত্রীদের শত্রু বানিয়ে যে রাষ্ট্র মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করছে, সেটি বিশ্বের শান্তিবোধের জন্য বিপজ্জনক বার্তা।”
ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা বারবার রক্তে থেমে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষের বিবেক থামেনি।
ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে এক তরুণ অধিকারকর্মী কাঁদতে কাঁদতে বলেন—
“আমরা শুধু খাবার দিতে চেয়েছিলাম, গুলি নয়।”
শেষ কথা
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার এই অধ্যায় মানবসভ্যতার আয়নায় এক কঠিন প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—
ত্রাণ নিয়ে যাওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে মানবতা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?