• হোম > দেশজুড়ে > ‘মামলা–বাণিজ্য’: অভ্যুত্থান–পরবর্তী মামলা এখন রাজনীতি, অর্থ ও প্রতিশোধের খেলায়

‘মামলা–বাণিজ্য’: অভ্যুত্থান–পরবর্তী মামলা এখন রাজনীতি, অর্থ ও প্রতিশোধের খেলায়

  • শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১১
  • ৬২

---

গণ–অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটলেও, সেই সময়কার সহিংসতা ও থানায় হামলার ঘটনায় ফেনীতে যেসব মামলা হয়েছে, তা এখন নতুন এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার নামে দায়ের হওয়া বহু মামলাই হয়ে উঠেছে ‘মামলা–বাণিজ্য’। এতে শুধু রাজনৈতিক নেতারা নয়, ব্যবসায়ী, প্রবাসী, এমনকি নিরীহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ছেন জটিলতার জালে।

জামাল গাজীর গল্প

অভ্যুত্থানের সময় ফেনী মডেল থানায় হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মো. জামাল উদ্দিন গাজী। চার মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এখন তিনি দাবি করছেন, আসলে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন, ষড়যন্ত্র করে তাঁকে মামলায় জড়ানো হয়েছিল। তাঁর দেওয়া নতুন এজাহারে আসামি হিসেবে নাম এসেছে ২৬৪ জনের, সঙ্গে আরও শতাধিক অজ্ঞাতনামা আসামি।

কিন্তু রহস্য হলো—বাদী স্বীকার করেছেন তিনি অনেক আসামিকে চেনেনই না। বিএনপির ফেনী পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি আবদুল মতিন পারভেজ নিজেই বলেছেন:

“পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এসে মামলার বাদী আমাকে চেনেন না বলে স্বীকার করেছেন। তাহলে আমার নাম এজাহারে কে দিল?”

মামলার পেছনে ‘লেনদেনের রাজনীতি’

প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, ফেনীতে মামলা এখন আর শুধু বিচারিক প্রক্রিয়া নয়; বরং একধরনের ব্যবসায়িক হাতিয়ার। অভিযোগ আছে—

  • ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে মামলা দেওয়া হয়।

  • কারও নাম বাদ দিতে চাইলে টাকা লাগে, না দিলে আসামি করা হয়।

  • কারাফটক থেকে জামিনে বের হতেও ঘুষ দিতে হয়—কখনও লাখ লাখ টাকা পর্যন্ত।

স্থানীয়রা বলছেন, মামলা এখন অনেকটা “বড়শি ফেলার মতো”। প্রথমে খসড়া এজাহার পাঠানো হয় লক্ষ্যবস্তু ব্যক্তিকে। যদি টাকা দেওয়া হয়, তবে নাম বাদ; আর না দিলে আসামির খাতায় নাম চলে আসে।

ভুক্তভোগীদের কণ্ঠ

একজন ব্যবসায়ী জানান, বিদেশে ১৯ বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি ঢাকায় ব্যবসা শুরু করেন। হঠাৎ দেখেন, ফেনীর একটি মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। আগে হোয়াটসঅ্যাপে একটি খসড়া এজাহার পাঠানো হয়েছিল তাঁর কাছে। টাকা না দেওয়ায় আসামি করা হয়।

একজন চিকিৎসক বলেন, হোয়াটসঅ্যাপে নিজের নাম দেখে আতঙ্কিত হয়ে ৪০ হাজার টাকা দেন। পরে থানায় গিয়ে জানতে পারেন, প্রথমে তাঁর নাম ছিল, পরে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আরেক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, জামিন পাওয়ার পর জেলগেটে আবার গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁকে ৪ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।

কারা নিয়ন্ত্রণ করছে?

তথ্য বলছে, ফেনীতে এই মামলা–বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ মূলত দুই স্তরে—

  1. রাজনৈতিক নেতৃত্ব: স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও জামায়াতের প্রভাবশালী নেতারা আসামির তালিকা নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের নামও যুক্ত হয়েছে।

  2. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ: পুলিশের কিছু কর্মকর্তা মামলার নামে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ে ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষভাবে ফেনী সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকীর নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁকে সম্প্রতি বদলি করা হয়েছে।

বিএনপি নেতাদের ভেতরের বিভক্তি

ফেনীতে বিএনপির রাজনীতির ভেতরেও মামলা–বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। স্থানীয় দুই নেতা—আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া (ছোট মেজবাহ) ও যুবদলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন—এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। অভিযোগ রয়েছে, কারা আসামি হবে, কারা জামিন পাবে—এসবের সিদ্ধান্ত তাঁদের হাতেই থাকে। যদিও তাঁরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

কেন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে?

  • ২২টি মামলা হয়েছে ফেনীতে, যার মধ্যে ৭টি হত্যা মামলা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা।

  • আসামি প্রায় ২,২০০ জন নামীয় এবং আরও প্রায় ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা।

  • বাদীরা অনেক আসামিকে চেনেন না; আসামির নাম এসেছে রাজনৈতিক প্রভাবে।

  • মামলা হয়েছে ব্যবসায়ী, প্রবাসী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে।

মানবিক সঙ্কট

এখন ফেনীতে আতঙ্কের পরিবেশ। মানুষ জানে না, কবে কাকে আসামি করা হবে। অনেকেই ভয়ে এলাকায় ফিরতে পারছেন না। প্রবাসীরা দেশে আসতে দ্বিধায় আছেন। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ ঝুঁকিতে ফেলেছেন।

ফেনীর একজন বৃদ্ধ সাবেক চেয়ারম্যান, যিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তিনিও জামিনে বের হওয়ার পর আবার গ্রেপ্তার এড়াতে কয়েক লাখ টাকা খরচ করেছেন। এটি কেবল আইনের অপব্যবহার নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

উপসংহার

ফেনীতে মামলা এখন বিচার নয়, বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। স্থানীয় রাজনীতি, প্রশাসনিক স্বার্থ ও ব্যক্তিগত প্রতিশোধের খেলায় সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ছেন দুর্ভোগে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া এখন মানুষের কাছে ন্যায়বিচারের প্রতীক নয়; বরং ভয়, আতঙ্ক ও অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/5194 ,   Print Date & Time: Wednesday, 26 November 2025, 08:25:04 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh