সমুদ্রপথে গাজার মানুষদের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল এক অভূতপূর্ব নৌবহর—গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। ৪০টিরও বেশি নৌযানে ৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ অধিকারকর্মী, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁদের একটাই লক্ষ্য—ইসরায়েলের কঠোর অবরোধ ভেঙে গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া।
কিন্তু গাজা উপকূল থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি সেনারা নৌবহরটির অন্তত আটটি নৌকা থামিয়ে দেয়। এরপর দুই শতাধিক অধিকারকর্মীকে আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে আছেন বিশ্বখ্যাত সুইডিশ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ।
অবরোধ ভাঙার চেষ্টা ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
২০০৭ সাল থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর গাজা কার্যত এক খোলা কারাগারে পরিণত হয়। অবরোধ, যুদ্ধ আর বিমান হামলায় লাখো মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সাম্প্রতিক দুই বছরের নৃশংস হামলায় নিহত হয়েছেন ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার অভাবে লাখো শিশু মৃত্যুমুখে।
ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছিল, তারা যেকোনো মূল্যে গাজামুখী নৌযান থামাবে। তাদের দাবি—এটি “আইনসম্মত অবরোধ” ভাঙার চেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই পদক্ষেপই আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আটককৃতদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা
অধিকারকর্মীদের মধ্যে ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার আইনজীবীরা। সবচেয়ে আলোচিত নাম গ্রেটা থুনবার্গ, যাকে ডেকের ওপর বসা অবস্থায় ইসরায়েলি সেনাদের ঘেরাও করতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ থেকেও অংশ নিয়েছেন দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তাঁর হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা গেছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ফ্লোটিলার আটক হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই রোম, মিলান, ইস্তাম্বুল, বুয়েনস আইরেসসহ বিভিন্ন শহরে রাতেই বিক্ষোভ শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছে এবং গাজার জন্য অবাধ মানবিক সহায়তা নিশ্চিতের দাবি তুলছে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনাকে গভীর উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
এ ঘটনা নতুন নয়। ২০১০ সালে তুরস্কের মাভি মারমারা জাহাজে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ১০ জন অধিকারকর্মীকে হত্যা করেছিল। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি ফ্লোটিলা ইসরায়েলি সেনাদের দ্বারা আটক হয়েছে। যদিও বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু গাজার মানুষের জন্য প্রকৃত কোনো সমাধান আসেনি।
মানবিক সংকটের গভীরতা
গাজার মানুষ আজ অবরোধের মাঝে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। এক ফ্লোটিলা কর্মী বলেছেন—
“আমরা কোনো অস্ত্র বহন করছি না, কেবল রুটি আর ওষুধ নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তবুও আমাদের থামানো হলো। তাহলে গাজার শিশুদের জন্য খাবার পাঠানোও কি অপরাধ?”
এই প্রশ্ন বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।
উপসংহার
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার যাত্রা হয়তো গন্তব্যে পৌঁছায়নি, কিন্তু এটি আবারও প্রমাণ করল—গাজার মানবিক সংকট শুধু ফিলিস্তিনিদের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক ইস্যু। প্রশ্ন রয়ে গেল—অবরুদ্ধ শিশুদের মুখে রুটি পৌঁছে দেওয়াটাই যদি অপরাধ হয়, তবে মানবতার সংজ্ঞা কোথায়?