গণ-অভ্যুত্থানের পর পতিত সরকারের সংবিধান ও আমলাতন্ত্র রেখে দেওয়ার কড়া সমালোচনা করেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, জনগণের রক্ত, আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত এই অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ও অভিপ্রায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়নি।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ আয়োজিত ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব মন্তব্য করেন।
গণ–অভ্যুত্থানের চেতনা থেকে বিচ্যুতি
ফরহাদ মজহার বলেন,
“আপনি তো গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এসেছেন, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের কেউ নন। এখানে যারা বসে আছেন, তারা অনেকেই রাস্তায় বুক পেতে দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। অথচ আজ সেই অভিপ্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার গণ–অভ্যুত্থানের সত্তা বোঝেনি। জনগণের রক্ত দিয়ে গড়ে ওঠা অভ্যুত্থানের জায়গায় ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা দেশের জন্য বিপজ্জনক।
নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা
এই চিন্তক বলেন,
“গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করা। অথচ এখন বৈধতা নিশ্চিত না করে নির্বাচনের আয়োজন চলছে।”
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সফল নির্বাচনের কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। তাঁর প্রশ্ন,
“এত বড় আত্মত্যাগের পরে কিসের ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা বলছেন? দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবেন না।”
রাজনৈতিক দল নয়, লুটেরা শ্রেণি
রাজনীতির বর্তমান কাঠামোকে ‘লুটেরা শ্রেণি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ফরহাদ মজহার বলেন,
“বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। রাজনৈতিক দল মানে জনগণের সেবা করা, জাতিকে নতুন দিক দেখানো। কিন্তু এখানে যা আছে, তারা কেবল দুর্নীতিবাজ।”
তিনি আরও বলেন, উপদেষ্টারা জনগণের সঙ্গে নয়, বরং দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ করছেন। এতে গণ–অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে।
সংবিধান ও বৈধতার প্রশ্ন
শেখ হাসিনার সংবিধান রেখে তার অধীনে শপথ নেওয়ার সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন,
“আপনারা একটি অবৈধ সরকার। তবে অবৈধ বলার মানে এই নয় যে আপনাদের চাই না। এর মানে হচ্ছে, আপনারা প্রথমে নিজের বৈধতা নিশ্চিত করুন।”
তিনি স্পষ্ট করে দেন, রাষ্ট্র কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়:
“রাষ্ট্র মানে গ্রামীণ ব্যাংক চালানো নয়।”
তরুণদের বিভাজন ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব
অন্তর্বর্তী সরকার তরুণ শিক্ষার্থীদের মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করাকে তিনি ইতিবাচক উদ্যোগ বলে স্বাগত জানান। তবে বলেন, শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্রের কারণে তরুণদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেওয়া হয়নি। এতে তরুণদের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াত ও পুনর্জাগরণের প্রসঙ্গ
আলোচনায় ফরহাদ মজহার বলেন, জামায়াতের অতীত ইতিহাসে ইতিবাচক দিক থাকলেও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় দলটির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ধ্বংস করেছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ইসলামের নতুন কোনো পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়াও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সভার অন্যান্য বক্তব্য
সভায় জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আচরণের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ফোনালাপ এড়িয়ে সরাসরি দেখা করার প্রবণতা সন্দেহজনক।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক সচিব ও কূটনীতিক আবদুল্লাহ আল মামুন, আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাক, জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মজুমদার প্রমুখ। সভা সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সাদেক রহমান।
উপসংহার
ফরহাদ মজহারের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, গণ–অভ্যুত্থানের চেতনা জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রূপায়িত হয়নি। রাষ্ট্রের বৈধতা প্রতিষ্ঠা, প্রকৃত রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা এবং তরুণদের নেতৃত্বে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে আস্থা আনতে পারবে না।