বিশ্বজুড়ে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা না থাকা কোনো কোম্পানির আমদানি করা ওষুধে শতভাগ শুল্ক আরোপ করা হবে। শুধু তাই নয়, ভারী ট্রাকে ২৫ শতাংশ, রান্নাঘর ও বাথরুমের ক্যাবিনেটে ৫০ শতাংশ এবং আগামী সপ্তাহ থেকে সোফা ও অন্যান্য গদিযুক্ত আসবাবপত্রে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানবিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। কারণ এই শুল্ক শুধু কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের নয়—সরাসরি আঘাত করবে সাধারণ নাগরিক, শ্রমজীবী মানুষ এবং বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল লাখো পরিবারকে।
ট্রাম্পের যুক্তি
ট্রাম্পের দাবি, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদকদের বাঁচাতে জরুরি। বাইরের দেশ থেকে ব্যাপক আমদানি আমেরিকান শিল্পকে দুর্বল করছে। তিনি উল্লেখ করেছেন— পিটারবিল্ট ও ম্যাক ট্রাকস্ এর মতো মার্কিন কোম্পানিগুলো এ সিদ্ধান্তের ফলে বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা পাবে।
তার ভাষায়—
“আমাদের শিল্পকে আবার শক্তিশালী করতে হবে, বাইরের চাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। আমেরিকান শ্রমিকদের জন্য এই সিদ্ধান্তই সুরক্ষা।”
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা
কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর যুক্তি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্স আগেই সতর্ক করে জানিয়েছিল, শুল্ক আরোপে ব্যয় বেড়ে যাবে, কারণ ট্রাকের যন্ত্রাংশ, আসবাবপত্র ও ওষুধ তৈরির জন্য অনেক উপকরণ আসে মেক্সিকো, কানাডা, জাপান, জার্মানি ও ফিনল্যান্ড থেকে। এরা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অংশীদার ও মিত্র।
চেম্বারের মতে—
-
“দেশীয়ভাবে এসব যন্ত্রাংশ উৎপাদন করা অবাস্তব।”
-
“শুল্কের ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, ভোক্তাদের ওপর চাপ পড়বে।”
-
“কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না বরং কমে যাবে।”
বৈশ্বিক প্রভাব
এই নতুন শুল্কনীতি ৯০টিরও বেশি দেশে প্রভাব ফেলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার মতো অংশীদাররা এখন বিকল্প অর্থনৈতিক পথ খুঁজছে। এতে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন—
-
শুল্ক আরোপে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়তে পারে।
-
দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে রপ্তানি নির্ভর কারখানার শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।
-
ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমবে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ
শুল্কনীতি সাধারণত অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচিত হলেও এর প্রভাব মানবিক দিক থেকে গভীর।
-
আমেরিকায় শ্রমিকদের চাকরি হয়তো সাময়িকভাবে বাড়তে পারে, কিন্তু ভোক্তাদের জীবনযাত্রার খরচ আকাশচুম্বী হবে।
-
উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে মার্কিন বাজারের ওপর লাখো পরিবার নির্ভরশীল, শুল্কের কারণে আয় ও কাজের সুযোগ হ্রাস পাবে।
-
ওষুধে শতভাগ শুল্ক মানে— দরিদ্র রোগীরা যুক্তরাষ্ট্রে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ আরও ব্যয়বহুল দামে কিনতে বাধ্য হবেন।
এটি শুধু অর্থনীতির খেলা নয়, এটি মানুষের জীবনের লড়াই। যখন একটি নীতির কারণে ওষুধ, খাদ্য বা আশ্রয় ব্যয়বহুল হয়ে যায়, তখন তা সরাসরি মানবাধিকারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
ট্রাম্প বলছেন, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য—
-
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পুনরুজ্জীবিত করা
-
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা
-
আমেরিকান শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা
কিন্তু সমালোচকদের মতে, এর পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থও কাজ করছে। আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্প নিজেকে “শ্রমিকবান্ধব” প্রমাণ করতে চাইছেন।
উপসংহার
ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এক নতুন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ শিল্প রক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য হয়তো মহৎ, কিন্তু এর মানবিক মূল্য অনেক বেশি।
শুল্ক আরোপ মানে শুধু কোম্পানি বা ব্যবসার ওপর চাপ নয়; এর মানে হলো— সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের খাবার, ওষুধ, আসবাব, পরিবহন—সবকিছুর দাম বাড়া। এক দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পুরো বিশ্বের শ্রমিক, কৃষক, ভোক্তা ও রোগীদের জীবনে প্রভাব ফেলছে।
বিশ্ব এখন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি: আমেরিকার সুরক্ষা কি বিশ্বের দুর্ভোগের বিনিময়ে হবে?