বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আগামী পথচলা নিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা আবারও স্পষ্ট হলো। রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার ভবনে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রকাশিত ‘পিপলস ইলেকশন পালস সার্ভে, রাউন্ড–২’ এর ফলাফলে উঠে এসেছে— দেশের নাগরিকরা সময়মতো নির্বাচন চান, নিরাপদ ভোট চান, আর চান গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হোক।
এই জরিপে অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার ৪১৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। তাদের উত্তরগুলো কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং মানুষের মনের গভীর চাওয়া-পাওয়ার প্রতিচ্ছবি।
সময়মতো নির্বাচনের জনদাবি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ নাগরিক চান জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হোক। এ শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার প্রকাশ।
আরও বড় তথ্য হলো— ৯৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার জানিয়েছেন তারা ভোট দিতে আগ্রহী। অর্থাৎ জনগণ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, তারা তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে চায়, তারা গণতন্ত্রে অংশ নিতে প্রস্তুত।
অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়ন
মানুষ সরকারের কর্মকাণ্ড দেখছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে ‘ভালো’ বা ‘মধ্যম মানের’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে তরুণ, শিক্ষিত ও নগরবাসীর মধ্যে সন্তুষ্টি কম।
তরুণদের এই সংশয় গুরুত্বপূর্ণ— কারণ ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠনে তারাই প্রধান শক্তি। তাই তাদের আস্থা অর্জন এখন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ভোটের পরিবেশ ও নিরাপত্তা
মানুষ শুধু নির্বাচনের আয়োজনেই আস্থা রাখতে চাইছে না, তারা নিরাপদ পরিবেশও প্রত্যাশা করছে। জরিপ অনুযায়ী—
-
৬৯ দশমিক ৯ শতাংশ নাগরিক বিশ্বাস করেন অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম।
-
৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ মনে করেন তারা নিরাপদে ভোট দিতে পারবেন।
তবে পুলিশ ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তরুণ ও নগরবাসীর মধ্যে সংশয় বেশি। এ বাস্তবতা মোকাবিলা না করলে নির্বাচনের আস্থা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আইনশৃঙ্খলার চিত্র
জরিপে দেখা গেছে, ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিক মনে করেন গত ছয় মাসে চাঁদাবাজি বেড়েছে। নগর এলাকায় বসবাসকারী তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে এই সমস্যা অনুভব করছে।
তাদের তথ্যের প্রধান উৎস হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এ থেকেই বোঝা যায়— নাগরিকরা তথ্য পাচ্ছে, প্রশ্ন তুলছে, এবং জবাব চাইছে।
সংস্কারের প্রশ্নে সচেতনতার অভাব
প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি নিয়ে সচেতনতার ঘাটতি বড়। জরিপে দেখা যায়— ৫৬ শতাংশ ভোটার এই ব্যবস্থার বিষয়ে কিছুই জানেন না।
তবে যারা জানেন, তাদের মধ্যে সমর্থন বেশি। বিশেষ করে তরুণ ও উচ্চশিক্ষিতরা নির্বাচনী সংস্কারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সাইমুম পারভেজ, বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী এ কে এম ফাহিম মাশরুর, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রশনা ইমাম এবং ব্রেইনের নির্বাহী পরিচালক শফিকুর রহমান।
তারা একবাক্যে বলেছেন— জনগণের আস্থা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া সফল হতে পারে না।
মানুষের প্রত্যাশা: নিরাপদ ভোট, সময়মতো নির্বাচন
বাংলাদেশের মানুষ বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বারবার প্রমাণ করেছে, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আজও সেই বিশ্বাস অটল।
সার্ভের ফলাফল স্পষ্ট করে দিয়েছে— জনগণের দাবি সহজ ও সরল: “ভোট চাই সময়মতো, ভোট চাই নিরাপদে।”
এবার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের— জনগণের সেই আশা পূরণ করা। কারণ গণতন্ত্র কেবল একটি শব্দ নয়, এটি মানুষের অধিকার, মানুষের আশা, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।