নবীর জীবনীকে আরবিতে ‘সিরাত’ বলা হয়, যার অর্থ জীবনপথ বা চলার ধারা। ইসলামী পরিভাষায় সিরাতুন্নবী বলতে নবী (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত বোঝানো হয়, যেখানে তাঁর জন্ম থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা, চরিত্র, আদর্শ, সংগ্রাম, যুদ্ধ, শান্তি, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক আচরণ, শাসননীতি ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়। সিরাত অধ্যয়ন শুধুমাত্র একজন মহাপুরুষের গল্প নয়, বরং আল্লাহ প্রদত্ত এক আলোকবর্তিকা যা মানবসমাজের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে।
কোরআন বোঝার অপরিহার্য সূত্র
পবিত্র কোরআন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি, যাতে আপনি মানুষের কাছে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন।” (সুরা: নাহল, আয়াত: ৪৪)। কোরআনের অনেক আয়াত নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছে, যেমন বদরের যুদ্ধ, হিজরতের মুহূর্ত, হুদায়বিয়ার সন্ধি, বা উহুদের যুদ্ধের বেদনাময় মুহূর্ত। এসব ঘটনার সঙ্গে সিরাত সরাসরি যুক্ত। সিরাত না জানলে, কোরআনের আয়াতগুলো শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান হয়ে থেকে যায়; তবে সিরাত জানলে আয়াতের বাস্তবতা আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
রাসুল (সা.)-কে অনুসরণের পূর্বশর্ত
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সুরা: আহজাব, আয়াত: ২১)। রাসুল (সা.)-এর জীবন, তাঁর ইবাদত, লেনদেন, পরিবার পরিচালনা, শাসননীতি সব কিছুই আমাদের জীবনের জন্য নিখুঁত দিকনির্দেশনা। সিরাত অধ্যয়নের মাধ্যমে এই নির্দেশনাগুলো সহজ ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ঈমানের দৃঢ়তা ও সাহসের উৎস
মক্কার নির্যাতন, তায়েফের অপমান, উহুদের যুদ্ধে আহত শরীর, এবং হিজরতের প্রাণঘাতী ঝুঁকি—এমন চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাসুল (সা.) যেভাবে ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসা রেখে এগিয়েছেন, সিরাত পাঠের মাধ্যমে আমরা তার প্রেরণা পেতে পারি। সিরাতের প্রতিটি অধ্যায় ঈমানকে শক্তিশালী করে, সাহস যোগায় এবং আমাদের জীবনে আশার আলো নিয়ে আসে।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের রূপরেখা
রাসুল (সা.) শুধু আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকই ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রনায়ক, বিচারক, সেনাপতি, এবং কূটনীতিকও ছিলেন। তাঁর মদিনার সনদ মানবাধিকার ও সামাজিক সমতার প্রথম লিখিত দলিল। তাঁর শাসননীতি ছিল ন্যায়ভিত্তিক, অর্থনীতি ছিল দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল, এবং যুদ্ধনীতি ছিল মানবিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আধুনিক বিশ্বের যেসব সমাধান প্রয়োজন, তার সবই সিরাতের ভেতর নিহিত।
রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি
রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার বাবা, সন্তান এবং সমগ্র মানবজাতির চেয়েও বেশি প্রিয় হই।” (বুখারি, হাদিস: ১৫)। সিরাত অধ্যয়ন করলে আমরা তাঁর প্রতিটি হাসি, কান্না, সিদ্ধান্ত এবং দোয়া অনুভব করতে পারি, যা সত্যিকারের মহব্বত সৃষ্টি করে।
মানবতার সর্বজনীন পাঠ
মহানবী (সা.)-এর জীবন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার জন্য শিক্ষা। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে শত্রুকে ক্ষমা করতে হয়, কিভাবে দাস-দাসীর সঙ্গে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, এবং কিভাবে নারীর সম্মান রক্ষা করতে হয়। তাঁর জীবনী থেকে জানা যায় যে, ইসলাম শুধু ইবাদতের ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবমুক্তির জীবনব্যবস্থা।
উপসংহার
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সিরাতের আলোয় আলোকিত হয়ে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, তাকমিল ফিল হাদিস, জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা