• হোম > ফিচার > হরিজন সম্প্রদায়: বাংলাদেশের ‘অচ্ছুৎ’ মানুষদের অভিশপ্ত জীবনের গল্প।

হরিজন সম্প্রদায়: বাংলাদেশের ‘অচ্ছুৎ’ মানুষদের অভিশপ্ত জীবনের গল্প।

  • বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০, ১৯:২২
  • ২৭১৪

---“আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই”, রাগতস্বরে বলছিলেন রতন বাশফুর। বাশফুররা এখানে অচ্ছুৎ, বাংলাদেশের একদম নিচু জাতের মানুষ তারা। রতন বাশফুরের পদবিই বলে দিচ্ছে সমাজে তার অবস্থান কোথায়। বাশফুররা ‘মেথর জাতে’র অন্তর্ভুক্ত, তারা থাক হরিজন পল্লীতে। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বড়সড় বস্তিপল্লী গড়ে তুলে মানবেতর জীবনযাপন করে যাওয়া এক সম্প্রদায় তারা। ময়মনসিংহের হরিজন পল্লীতে ১,২০০ বস্তিতে বসবাসরত বাশফুররা একেকটি ঘরে কম করে হলেও পাঁচজন লোক থাকে। ঠিক একই অবস্থা অন্য পল্লীগুলোরও। স্বদেশে থেকেও হরিজনরা যেন পরদেশী। নিজ সমাজের কাছেই অস্পৃশ্য তারা। তাদের এই করুণ জীবনের গল্প শোনার মতো সময়ও নেই কারো। অথচ তারাই আমাদের দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজে নিয়োজিত থেকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলছেন আমাদের জীবন।

হরিজন পল্লীতে বসবাস করা মানেই স্যানিটেশনের যাচ্ছেতাই অবস্থা, কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সময়ে-অসময়ে বন্যায় ভেসে যাওয়া, পচা-বাসি খাবার খাওয়া- সভ্য জগতের কাছে একেবারেই অকল্পনীয় একটি জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। তাদের বস্তিগুলো সাধারণ বস্তির মতো নয়। সেখানে বিল্ডিং তৈরি করা আছে, তবে সেই বিল্ডিংয়ের চারপাশে পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করার গাড়ির কোনো নামগন্ধও পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা যেন এমন- মেথরদের আবার স্যানিটেশন কী?

সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার কারণেই দেশের সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে হরিজন সম্প্রদায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাটির বিষবৃক্ষ রোপণ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আর্যরা। তারপর বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ক্রমাগত সেই জাত-পাতের বিভাজন করেই গেছেন। এই বিভাজন সামাজিকভাবে এমন নির্যাতনে রূপ নিয়েছিল যে, সমাজে নিম্নবর্ণের মানুষের টেকাই দায় হয়ে উঠেছিল। তাদের অস্তিত্বের সংকট শুরু হয়ে যায় রীতিমতো। ভারতবর্ষে এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি ঘটে বিভিন্ন ধর্মের। কিন্তু জাতিভেদের সংকট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা বাংলাদেশ থেকে আজও যায়নি। ইতিহাসে সোনার অক্ষরে নয়, কান্নার নীল হরফে লেখা রয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের কথা।

হরিজন কথাটির উৎপত্তির সাথেও মিশে আছে প্রহসনের গল্প। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধী দলিতদের মেথর, সুইপার না বলে ‘হরিজন’ বলার অমোঘ বাণী দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের সমাজ ও সামাজিকতার স্বীকৃতি দেননি, মূল সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেননি। ক্ষমতা যখন যার হাতে থাকে, তখন সেই শাসক জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়ার মন্ত্র মুখে উচ্চারণ করলেও, বিভাজন টিকিয়ে রাখার জন্য একটি শাসক শ্রেণী ঠিকই তৈরি করে দিয়ে গেছেন। মহাত্মা গান্ধীর ‘হরিজন’ তার একটি প্রকাশ মাত্র। দেবদাসী প্রথা দক্ষিণ ভারতে এখনো টিকে আছে। এসব দেবদাসীরা অধিকাংশই হরিজন সম্প্রদায়ের থেকে আসা। ব্রাহ্মণরা তাদের দিনের পর দিন ভোগ করে। তাতে অবশ্য ব্রাহ্মণদের জাত যায় না, জাত যায় হরিজনদের হাতের জল পান করলে, অন্ন গ্রহণ
বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায়, যারা মূলত হরিজন নামে পরিচিত, এখনো সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশতে পারেনি। ফলে তারা কলোনি ভিত্তিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে ব্যাপক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। ঢাকা শহরের একটু বাইরে গেলেই দেখা যাবে দলিত-হরিজনরা যেন অস্পৃশ্য। তারা পানি খেতে দোকানে গেলেও আলাদা করে গ্লাস নিয়ে যেতে হয়। দক্ষিণবঙ্গে হরিজনরা কোনো বাড়িতে খেতে গেলে তাদের কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় অবদানকে অস্বীকার করা হবে। তাই তাদের সমাজের মূলধারায় সংযোজিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা খুব জরুরি। নাহলে তারা শিক্ষিত হলেও এখনো যে অচ্ছুৎ হয়ে রয়েছে, সেই অচ্ছুৎই রয়ে যাবে।

জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার মানুষরা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ করে ঐতিহাসিক বা পণ্ডিতদের কাছে ‘দলিত’ নামে পরিচিতি পায়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে দুই ধরনের দলিত জনগোষ্ঠীর দেখা মেলে। একটি বাঙালি দলিত শ্রেণী, অন্যটি অবাঙালি দলিত শ্রেণী। ২০১৩ সালে মাযহারুল ইসলাম এবং আলতাফ পারভেজের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বসবাসরত দলিতদের সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় মিলিয়নের মতো। বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়, যেমন- চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি সম্প্রদায় সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। এসব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ইসলাম ধর্ম জাতিভেদকে অস্বীকার করলেও এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকে পেশার কারণে সমাজে পদদলিত হয়ে রয়েছে, যেমন- জোলা, হাজাম, বেদে, বাওয়ালি।

সূত্র: roar বাংলা


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/448 ,   Print Date & Time: Friday, 6 June 2025, 08:17:50 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh