জাতীয় নির্বাচন বানচালে ‘ষড়যন্ত্রের ডালপালা মেলতে শুরু করেছে’ উল্লেখ করে সবাইকে সর্তক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তারেক রহমান।
রবিবার (৩১ আগস্ট) বিকালে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তু্লে ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা রকম ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলতে শুরু করেছে।”
‘‘তবে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে আমরা বিশ্বাস করি কোনও ষড়যন্ত্রই বিএনপির অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। সবাইকে সর্তক থাকতে হবে।”
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘৪৭ বছরের গৌরবান্বিত পথচলায় বিএনপি বরাবরই দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের সহযোগিতা এবং সমর্থন পেয়ে এসেছে।”
‘‘আসুন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে জনগণের কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ থেকে বিএনপি যেমন অতীতে বিচ্যুত হয়নি, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও আমরা বিচ্যুত হবে না। আপনার দল, আপনাদের দল, আমাদের দল বিএনপির শেকড় এই বাংলাদেশ। জনশক্তি জনবল বিএনপির মনোবল।’’
রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়। অনুষ্ঠানে বিএনপির ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।
‘পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল করে তোলা হচ্ছে’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে, অথবা জটিল করে তোলা হচ্ছে। বিবেক হচ্ছে মানবসমাজের সবচেয়ে বড় আদালত। এই বিবেকের আদালতেই আজ আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা দরকার, নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না—এই ধরনের উচ্চারণ ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ঐক্যকে দুর্বল করবে, নাকি পলাতক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির পুনরুত্থানের প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করবে।”
‘‘আমি বলবো, এখনও সময় আছে। আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। পরাজিত পলাতক অপশক্তি কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে রয়েছে।”
‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান’
তারেক রহমান বলেন, ‘‘পলাতক স্বৈরাচারের মতো বিএনপির বিজয় ঠেকানোর অপরাজনীতির পরিবর্তে আসুন, আগে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার গঠন করি সবাই মিলে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর আরও সব যৌক্তিক দাবি সমাধানের পথ খুঁজি আমরা।”
‘‘রাষ্ট্র রাজনীতিতে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শর্ত শিথিল করে নির্বাচনের পথে হাঁটাই এখন সময়ের দাবি। জনগণের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে যদি আমরা রাষ্ট্র এবং সমাজে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার বিশ্বাস—গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক দাবিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়নের পথ সহজ হয়ে যাবে।’’
‘নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা’
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আমি একটি কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই, আজকের এই দিনে বিএনপি মনে করে— রাজনীতি মানেই শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নয়, বরং নীতি মানে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ বিনির্মাণ।”
‘‘সেই লক্ষ্যেই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিএনপি কী ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে, বেশ কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জনগণের সামনে আমরা তুলে ধরেছি, বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে। বিএনপি শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি। কীভাবে কোন উপায় গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে, সে ব্যাপারেও বিএনপির পেপারওয়ার্ক চূড়ান্ত পর্যায়। বিএনপির গৃহীত পদক্ষেপগুলো সারা দেশে মা-বোন, তরুণ জনগোষ্ঠী, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জনগণের কাছে আমাদের পৌঁছে দিতে হবে। জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক আমাদের বজায় রাখতে হবে।”
‘অশুভ শক্তির তৎপরতা’
তারেক বলেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্র ঝুঁকিমুক্ত নয়। প্রায় এক বছর আগে আমি বলেছিলাম, আগামী নির্বাচনকে ঘিরে অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। জনগণ লক্ষ করতে শুরু করেছেন—নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতে সেই অশুভ শক্তির অপতৎপরতা সাম্প্রতিক সময় ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।”
‘‘পতিত, পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার যখন জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটছে, তখন কোনও কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তাদের দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নানা শর্ত আরোপ করছে এবং এই শর্ত আরোপ করে নির্বাচনের পথে হয়তো বা পরিকল্পিত উপায়ে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে বলে বহু মানুষ এরই ভেতরে ভাবতে শুরু করেছেন।”
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। কারণ বিএনপি মনে করে, আগে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচিত সরকার জনপ্রত্যাশা পূরণে যদি ব্যর্থ হয়—তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। যা গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্র্যাকটিস করা হয়ে থাকে।’’
‘‘পুঁথিগত সংস্কারের চেয়েও কার্যকর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা অনেক বেশি জরুরি। রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে সংস্কারের ব্যাপারে বিএনপি সম্পূর্ণভাবে একমত। সংস্কারের গুরুত্ব আছে বলেই বিএনপি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পরেও অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে নেওয়া সংস্কার প্রস্তাবে সক্রিয়ভাবে সমর্থন এবং সহযোগিতা দিয়েছে। আমি রাজপথের সহকর্মী সহযোদ্ধা প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে অবশ্যই। তবে জনগণের অধিকার চর্চা এবং প্রয়োগের পথে বাধা সৃষ্টি করে কোনও সংস্কারকেই টেকসই করা যাবে না।”
তারেক বলেন, ‘‘পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের অভিপ্রায়ের সরকার। তবে এই সরকারের কাছে অবশ্যই একটি দক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সরকারের মতো পারফরম্যান্স আশা করার কোনও যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।’’
‘‘সঙ্গত কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবে, তাদের দুর্বলতাও তত বেশি দৃশ্যমান হতে থাকবে। বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা যত বেশি প্রতীয়মান হবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানবিরোধী অপশক্তি ৫ আগস্ট নিয়ে তত বেশি বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ পাবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের রাজপথের সহযোদ্ধা গণপরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলাসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় তা স্পষ্ট।’’
‘মব বায়োলেন্সকে প্রশ্রয় নয়’
তারেক রহমান বলেন, ‘‘মব ভায়োলেন্সকে আমরা কেউ প্রশ্রয় দেবো না।”
‘‘নারীর সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকারের প্রতি শহীদ জিয়া, দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতিটি সৈনিক সংবেদনশীল এবং শ্রদ্ধাশীল থাকবে। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, মহানগর দক্ষিণের রফিকুল ইসলাম মজনু, যুবদলের এম মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানী, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক লুৎফুর রহমান বক্তব্য রাখেন।