• হোম > বাংলাদেশ > ডিজিটাল ডাক্তার: ভরসা নাকি ভীতি?

ডিজিটাল ডাক্তার: ভরসা নাকি ভীতি?

  • রবিবার, ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১৬:৫৪
  • ৬৩

---

আধুনিক হাসপাতালের উজ্জ্বল করিডোর থেকে শুরু করে গ্রামের অন্ধকার ঘরের কোণে—বাংলাদেশে এক অদৃশ্য স্বাস্থ্য বিপ্লব নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরা স্মার্টফোন এখন যেন চিকিৎসকের বিকল্প, স্মার্টওয়াচ যেন সারাক্ষণ সতর্ক থাকা স্বাস্থ্য রক্ষক। মোবাইল অ্যাপ জানাচ্ছে রক্তচাপ কত, ঘড়ি মাপছে হৃৎস্পন্দন, আবার ভিডিও কলে ডাক্তার দিচ্ছেন চিকিৎসা পরামর্শ। স্বাস্থ্য যেন এখন সত্যিই হাতের মুঠোয়।

এই ডিজিটাল বিপ্লব নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য গড়ে মাত্র ৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে ২৩ জন। এই ঘাটতি পূরণে টেলিমেডিসিন সেবা লাখ লাখ মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছে চিকিৎসার আলো। শহর থেকে গ্রাম, চিকিৎসার সীমানা ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ নিজের দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিজেই পর্যবেক্ষণ করছে, সময়মতো ডাক্তারকে ভিডিও কলে পাচ্ছে। করোনা মহামারির সময়ে এই প্রযুক্তিই হয়ে উঠেছিল জীবনের রক্ষাকবচ।

কিন্তু, এই আলোয় ছায়াও আছে। স্বাস্থ্য প্রযুক্তির বাড়তি ব্যবহার আমাদের নিয়ে যাচ্ছে নতুন এক ঝুঁকির দিকে—“ডিজিটাল মেডিক্যালাইজেশন”। যেখানে প্রতিটি স্বাভাবিক অনুভূতিকেও আমরা “চিকিৎসার যোগ্য সমস্যা” ভেবে ফেলছি। সামান্য বুক ধড়ফড় করলেই মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক, মাথা ধরলেই সন্দেহ মস্তিষ্কে টিউমার। অ্যাপের ডেটা দেখে মানুষ নিজেরাই রোগ নির্ণয় করে ফেলছে, ভুল চিকিৎসা নিচ্ছে, কখনো অপ্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে ছুটছে।

মনোবিজ্ঞান বলে—মানুষ নেতিবাচক তথ্যকে দ্রুত আঁকড়ে ধরে। অ্যাপ যদি দেখায় ঘুম কম হয়েছে বা হার্টবিট একটু বেড়েছে, অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শিশু ও কিশোররাও এখন ছোট বয়সেই স্বাস্থ্য অ্যাপ ব্যবহার করছে। ফলে ভবিষ্যতে তারা বেড়ে উঠতে পারে স্বাস্থ্য উদ্বেগ ও হীনমন্যতা নিয়ে।

চিকিৎসা শুধু ল্যাব রিপোর্ট নয়। চিকিৎসা মানে মানবিক স্পর্শ, ডাক্তার-রোগীর আস্থা, সহানুভূতি। অ্যাপ বা ডিভাইস এই সূক্ষ্ম মানবিক যোগাযোগ কখনোই দিতে পারবে না। প্রযুক্তি চিকিৎসককে সহায়তা করবে, কিন্তু প্রতিস্থাপন নয়—এটাই হতে হবে মূল দর্শন।

তাহলে করণীয় কী?
-স্বাস্থ্য অ্যাপ ও টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্মের মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
-ডিজিটাল স্বাস্থ্য সাক্ষরতা বাড়াতে হবে, যেন মানুষ ভুল তথ্য চিনতে পারে।
-কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
-সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাকে যৌথভাবে মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।
-সবচেয়ে বড় কথা—মানুষকে বোঝাতে হবে, প্রযুক্তি হলো সহায়ক হাতিয়ার, চূড়ান্ত চিকিৎসক নয়।

বাস্তবতা হলো—ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা আমাদের দেশের জন্য বিপ্লবাত্মক সুযোগ। তবে এর ব্যবহার হতে হবে সচেতন ও মানবিক। প্রযুক্তির ঝলমলে স্ক্রিনে শুধু সবুজ আলো দেখলেই আমরা যেন সুস্থতার সংজ্ঞা খুঁজে না ফিরি। সুস্থতা মানে হলো ভালোভাবে বেঁচে থাকা, মানসিক শান্তি, সামাজিক সংযোগ এবং জীবনের অর্থময়তা।

বাংলাদেশ এখন এক সংবেদনশীল মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তি আমাদের শক্তি হয়ে উঠবে, নাকি উদ্বেগের নতুন রোগ তৈরি করবে—তা নির্ভর করছে আমরা কীভাবে এটিকে ব্যবহার করি তার ওপর। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত—প্রযুক্তি দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো, স্বাস্থ্য ভীতি নয়।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/4282 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 01:04:56 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh