• হোম > প্রধান সংবাদ > ব্যাংক একীভূতকরণ—নতুন সংকট নাকি সমাধান?

ব্যাংক একীভূতকরণ—নতুন সংকট নাকি সমাধান?

  • শনিবার, ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০৪
  • ২৫

---

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত কয়েক বছর ধরেই নানামুখী সংকটে জর্জরিত। আমানত কমছে, ঋণখেলাপি বাড়ছে, তারল্য সংকট তীব্র হচ্ছে। এই অবস্থায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—এটি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, নাকি চাপিয়ে দেওয়া একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নতুন করে ব্যাংকিং খাতকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে?

একীভূতকরণের পেছনে কারণ

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, একীভূত প্রক্রিয়ার জন্য প্রায় সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। এখন শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বক্তব্য শোনার পালা। আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের সংকট কাটিয়ে তোলা এবং দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা।

কোন ব্যাংকগুলো একীভূত হচ্ছে?

যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা হলো:

  • ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

  • ইউনিয়ন ব্যাংক

  • গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক

  • সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

  • এক্সিম ব্যাংক

তবে শুরু থেকেই এক্সিম এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেছে। বিশেষ করে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক এবং তার সহকর্মীরা চিঠি দিয়ে প্রক্রিয়া থেকে ব্যাংকটিকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা অন্যায্য ও বেআইনি।

মূলধন ঘাটতি এবং সরকারের সহায়তা

একীভূতকরণের খরচ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এর মধ্যে ২৫ হাজার কোটি টাকা সরকারি বাজেট থেকে চাওয়া হয়েছে, এবং বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানত বিমা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে। তবে, এজন্য বর্তমান আমানত বিমা আইন সংশোধন করতে হবে, কারণ বর্তমানে ওই তহবিল শুধুমাত্র ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়।

এই অর্থের জোগান শেষ পর্যন্ত জনগণের টাকাতেই হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে চাপ ফেলতে পারে।

সংকটের ভয়াবহতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, পাঁচটি ব্যাংকের আমানত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। বিপরীতে ঋণ ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে বড় অংশ খেলাপি ঋণ। বর্তমানে এই পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ।

বিশেষভাবে, ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটির ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ শতাংশ। এর ফলে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা

একীভূতকরণ হলে নতুন ব্যাংকের অনেক শাখা একই এলাকাতে পড়বে, ফলে কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গণহারে ছাঁটাই এড়াতে গ্রামীণ এলাকায় নতুন শাখা খোলা হবে এবং স্থানীয় আমানত স্থানীয় এলাকায় বিনিয়োগ করা হবে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

শেখ হাসিনা সরকারের সময়েও একাধিক ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি নতুন আইন—রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট-২০২৫—প্রণয়ন করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংক টেকওভার এবং একীভূতকরণের পূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতামত

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একীভূতকরণ টেকসই সমাধান হতে পারে না। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহিমদা খাতুন বলেন, “আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংক একীভূত করার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। দুর্বল ব্যাংক নিজেদের শক্তিশালী ব্যাংককে প্রস্তাব দেয় এবং তারপর অডিট করে প্রকৃত অবস্থা যাচাই হয়। বাংলাদেশে একীভূতকরণ কার্যক্রম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলে তা সংকটকে আরও জটিল করতে পারে।”

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আখতার হোসেন জানান, ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতে পারে, এবং এই অর্থ বিদেশি সহযোগিতার মাধ্যমে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আপত্তি

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন মনে করেন, তাদের ব্যাংক ইতোমধ্যেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তাই একীভূতকরণের কোনো প্রয়োজন নেই। তার দাবি, সাবেক চেয়ারম্যান মজুমদারের নামের কারণে এক্সিম ব্যাংককে এ প্রক্রিয়ায় টানা হচ্ছে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা অভিযোগ করেছেন, এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটিকে দখল করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, এবং এখন প্রকৃত উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটিকে টানা হচ্ছে। তারা এই প্রক্রিয়াকে বেআইনি এবং অন্যায্য বলছেন।

শেষ কথা

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে একটি বড় সংকটের মুখে রয়েছে। পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণ নিঃসন্দেহে একটি বড় পদক্ষেপ, তবে এর সফলতা নির্ভর করছে এই প্রক্রিয়াটির বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা এবং সঠিক পরিকল্পনার ওপর। একদিকে, গ্রাহকদের টাকা সুরক্ষিত থাকবে, অন্যদিকে সরকার ও দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়তে পারে।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/4215 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 10:43:21 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh