বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মই জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুনভাবে সাজাবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে তরুণরা যে নেতৃত্ব দিয়েছে, তার মধ্য দিয়েই দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এই প্রজন্ম অতীতের বিভাজন থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়ে যাবে একটি গঠনমূলক ও জ্ঞানভিত্তিক ভবিষ্যতের দিকে।
শুক্রবার রাজধানীতে আয়োজিত ‘বেঙ্গল ডেল্টা কনফারেন্স ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সম্মেলনে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। বক্তব্যে তৌহিদ হোসেন তরুণদের সক্ষমতা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “তারা হয়তো চলার পথে ভুল করবে, কিন্তু সময় ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারা একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে।”
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের দৃঢ়তা ও সাহস না থাকলে আজকের এই পরিবর্তন সম্ভব হতো না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন, নতুন প্রজন্ম আর কখনোই বাংলাদেশকে অতীতের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পথে ফিরতে দেবে না।
বিশ্ব রাজনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বর্তমানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি পুরোপুরি বদলে দিচ্ছে। এগুলো হলো—ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় গণহত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে পশ্চিমা জনমত ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে সমর্থনের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বেড়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, একসময় চীনকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক জোরদার হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে তাতেও পরিবর্তনের আভাস দেখা যাচ্ছে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এটা ভেবে নেওয়া উচিত হবে না যে সবকিছু স্থায়ীভাবে বদলে গেছে। ভারত, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও মূল ভূ-রাজনৈতিক ভিত্তি আগের মতোই অটুট রয়েছে।
ড. তৌহিদ হোসেন জোর দিয়ে বলেন, একবিংশ শতাব্দী নিঃসন্দেহে একটি “এশীয় শতক” হবে। এরপরে বাইশ শতকে আফ্রিকার উত্থান ঘটতে পারে, যদি তারা জনসংখ্যাগত সুবিধা কাজে লাগাতে পারে এবং নিজেদের সম্পদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার মতে, আট বছর ধরে এটি শুধু জাতীয় সমস্যা নয়, বরং এখন এটি আঞ্চলিক হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। প্রায় দশ লাখ তরুণ রোহিঙ্গা, যাদের অনেকেই কৈশোর বা বিশের কোঠায়, তাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য শিবিরে আটকে রাখা সম্ভব নয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, এটা ভাবা বোকামি হবে যে তারা চিরকাল একটি আশাহীন জীবন মেনে নেবে। এই সংকটের সমাধান না হলে তা বাংলাদেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত একটি গুরুতর আঞ্চলিক, এমনকি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত হবে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘শিক্ষাগত বর্ণবৈষম্যপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, যেখানে একটি ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণি বিশ্বমানের শিক্ষা পাচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ শিশু, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে না, ইংরেজির দক্ষতা তো আরও দূরের কথা। তিনি বলেন, এই বৈষম্যই জাতীয় অগ্রগতিকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
ড. তৌহিদ হোসেন বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, এটি গণহারে শিক্ষার্থী ভর্তির কেন্দ্র না হয়ে একটি প্রকৃত গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে হবে। তার মতে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলেও বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, রাজনীতি হওয়া উচিত ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির একটি মাধ্যম। যাতে তাদের অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিতে না হয়। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দলগুলো ক্ষমতা চাইতে পারে, কিন্তু সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, জ্ঞান প্রসার এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ড. মাজলি বিন মালিক, নেপালের সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ড. দীপক গেওয়ালি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, দ্য ওয়্যার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারাদারাজান এবং ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক খান।
‘বেঙ্গল ডেল্টা কনফারেন্স ২০২৫’-এর আয়োজন করে ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্স (দায়রা)। জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ-রাজনৈতিক রূপান্তর এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে এ সম্মেলনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা একত্রিত হয়েছেন। সম্মেলনে বিশেষভাবে সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গঠনে তরুণদের ভূমিকা নিয়েও পৃথক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।