চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ৮৫ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ। রায়ে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে চাকরিচ্যুত হওয়ার সময় থেকে তারা যে বকেয়া বেতনভাতা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন তা জ্যেষ্ঠতাসহ ফেরত দিতে হবে। এছাড়া বরখাস্তকালীন সময়কে বিশেষ ছুটি হিসেবে গণ্য করতে হবে।
সোমবার (১৮ আগস্ট) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির দেওয়া ১৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
রায়ের পটভূমি
২০০৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে ৩২৭ জনকে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের এই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে ৮৫ জন কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হিসেবে চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুত করা হয়।
চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা ন্যায়বিচারের জন্য মামলা করেন। কিন্তু ২০০৯ সালের মার্চে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তাদের মামলা খারিজ করে দেয়। তারা উচ্চতর আদালতে আপিল করলে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল ২০১০ সালের এপ্রিলে তাদের পক্ষে রায় দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষ আপত্তি জানিয়ে লিভ টু আপিল করলে ২০১০ সালে আপিল বিভাগের চেম্বার বেঞ্চ ওই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে সরকারপক্ষ পৃথক আপিল করে। ২০২২ সালে আপিল বিভাগ প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করলে তাদের চাকরিতে ফেরার পথ রুদ্ধ হয়।
পুনর্বিবেচনা ও চূড়ান্ত রায়
২০২৩ সালে চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) করেন। দীর্ঘ শুনানির পর চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ আগের সিদ্ধান্ত বদলে তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের নির্দেশ দেন। আজ সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলো।
আদালতে আইনজীবীদের বক্তব্য
আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন, প্রবীর নিয়োগী ও ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া।
মানবিক প্রভাব
এই রায়ের ফলে দীর্ঘ ১৭ বছরের অনিশ্চয়তা ও অবিচারের শিকার ৮৫ কর্মকর্তা আবার তাদের কর্মজীবনে ফিরতে পারবেন। শুধু চাকরিতে ফেরাই নয়, তারা বকেয়া বেতনভাতা, জ্যেষ্ঠতা এবং কর্মজীবনের মর্যাদা ফিরে পাবেন। অনেকে জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছেন কর্মহীন থেকে, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে হোঁচট খেয়েছেন—অবশেষে তারা ন্যায়বিচারের আলো দেখতে পেলেন।
জনমতের প্রতিক্রিয়া
মানবাধিকারকর্মী ও আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায় শুধু ৮৫ জন কর্মকর্তার জন্য নয়, বরং প্রশাসনিক ন্যায়বিচারের একটি দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক প্রভাব, অন্যায়ভাবে বরখাস্ত এবং দীর্ঘসূত্রতা যেন ভবিষ্যতে কারও জীবনে অমানবিক কষ্ট বয়ে না আনে—এই রায় সে বিষয়ে একটি বার্তা বহন করছে।