হিমালয়ের উজানে বাঁধ নির্মাণে বিপন্ন হচ্ছে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহ, জলজীবন ও আদিবাসী সংস্কৃতি—উঠছে তথ্য স্বচ্ছতা ও টেকসইতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন।
✍️ জাহিদুজ্জামান সৈয়দ
যেখানে নদীর স্রোত থামে, সেখানেই থেমে যায় জীবনের গতি।
ভারতের সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণাধীন ১২০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে হিমালয়ের পাদদেশে তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্বেগ—আর এর ছায়া পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভাটির গ্রামগুলোতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এমনিতেই ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী, কৃষি ও জীববৈচিত্র্য এখন আরও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। ক্ষুব্ধ আদিবাসী জনগোষ্ঠী, জলজ সম্পদের ক্ষয়, এবং প্রকল্পের স্বচ্ছতার অভাব—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন এক পরিবেশ-রাজনৈতিক সংকট।
ভাটির মানুষের শঙ্কা
“আমার ছেলে আজও জাল নিয়ে যায়, কিন্তু পানি নাই, মাছ নাই।”
বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের এক জেলে, মজিবর সরদার।
গত এক দশকে তিস্তা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ফসলের উৎপাদন কমেছে, নদীর চর মরে যাচ্ছে, এবং সুন্দরবনের লবণাক্ততা বাড়ছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গ্রীষ্মকালে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি।
উচ্ছেদ ও সংস্কৃতিহীনতার আশঙ্কায় লেপচারা
“আমাদের জমি মানে আমাদের পরিচয়। এখন সরকার বলছে, উন্নয়নের জন্য ছেড়ে দাও।”
বলছিলেন সিকিমের লেপচা আদিবাসী নেত্রী পাসাং ডোলমা।
তিস্তার পাড়ে বসবাসকারী লেপচারা প্রকল্পটিকে সরাসরি তাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছেন। অন্তত ৩০০ পরিবার ইতোমধ্যে উচ্ছেদের মুখে। লেপচাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে ‘দেনজং’ অঞ্চল ও ‘নুম্বু লেহ’ জলাশয় পবিত্র—যা বাঁধের আওতায় পড়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবনের ভবিষ্যৎও সংকটে
“লবণ পানিতে গাছ শুকায়ে যায়, মধু পাওয়া যায় না আগের মতো।”
— বুড়িগোয়ালিনির মৌয়াল রফিকুল ইসলাম।
তিস্তার উজানে পানিধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ফলে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের মতে, গত পাঁচ বছরে সুন্দরবনের ১২% অঞ্চলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে বাড়তি লবণাক্ততার কারণে।
তথ্য অস্বচ্ছতা ও দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের ঘাটতি
“এই প্রকল্প বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে কি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে?”
প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিদ ড. আইরিন ফেরদৌস।
সিকিমের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচালনা করছে NHPC Limited ও Sikkim Urja নামের একটি সংস্থা, যার ৬০% মালিকানা রয়েছে ভারতের বেসরকারি খাতে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখনো কোনো স্পষ্ট দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রমাণ মেলেনি, যা প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও প্রতিবেশগত নিরীক্ষার দাবি জোরদার করছে।
সমাধানের পথ: একসঙ্গে বসা জরুরি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা নদীকে ঘিরে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের অংশগ্রহণে একটি ‘নদীকূটনৈতিক ফোরাম’ গঠন সময়ের দাবি।
“নদী কোনো দেশের একার না—এর সঙ্গে লাখো জীবনের সম্পর্ক।”
— ব্যারিস্টার শামীম আরা, বাংলাদেশ পানি আইনজীবী ফোরাম।
উপসংহার
দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে বলি হতে থাকলে একে একে হারিয়ে যাবে সুন্দরবন, লেপচা পাহাড়, ভাটির কৃষিভিত্তিক জীবনধারা।
নদীর ওপর নির্ভরশীল এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সীমান্তের উভয়পারে বসে যৌথভাবে টেকসই সমাধানের পথ বের করার ওপর। সময় এখনই।