রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির সামনে অজানা ঝড়
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দীর্ঘদিন ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঘোষিত ৩৫% আমদানি শুল্ক — যা আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর — এই খাতকে এক নতুন অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। যেখানে আগে যুক্তরাষ্ট্রে গড় শুল্ক ছিল ১৫%, সেখানে হঠাৎ এই তিনগুণ বৃদ্ধির ঘোষণা এক ধরনের “শুল্ক-ভীতির” সৃষ্টি করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে।
অথচ বাংলাদেশ থেকেই আসে যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির একটি বড় অংশ। দেশের রপ্তানির ৮০%-এরও বেশি তৈরি পোশাক এবং প্রায় ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক এই খাতে নিয়োজিত, যার ৬০%-এর বেশি নারী। নতুন শুল্কনীতির ফলে শুধু রপ্তানি কমবে না, হুমকিতে পড়বে লাখ লাখ পরিবারের জীবন-জীবিকা।
শুল্ক তুলনা: বাংলাদেশ কতটা অস্বস্তিকর অবস্থানে?
দেশ আমদানি শুল্ক (২০২৫) মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতার অবস্থা
বাংলাদেশ ৩৫% তুলনামূলকভাবে সর্বোচ্চ ও ঝুঁকিপূর্ণ
ভিয়েতনাম ২০% যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রথম পছন্দ
ভারত ২২% নতুন উৎস হিসেবে আকর্ষণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, এই শুল্ক কাঠামো বাংলাদেশের জন্য আমেরিকান বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতা হারানোর আশঙ্কা তৈরি করছে। ফলে ক্রেতারা এখন ভিয়েতনাম বা ভারতমুখী।
ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিক্রিয়া: ‘অপেক্ষা করে দেখি’ মনোভাব
নতুন শুল্কের প্রভাবে বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। অর্ডার স্থগিত, উৎস পরিবর্তন ও অপেক্ষাকৃত সস্তা বিকল্প অনুসন্ধানের খবর পাওয়া গেছে।
ব্র্যান্ড দেশ প্রতিক্রিয়া
Gap Inc.: USA: নতুন অর্ডার স্থগিত, sourcing ভারতে স্থানান্তর
VF Corp. (Vans, North Face) USA: ‘On hold’ অবস্থানে, দীর্ঘমেয়াদে বিকল্প খোঁজ
Inditex (Zara) Spain: সরাসরি মন্তব্য না দিলেও অর্ডার প্রবাহ ধীর
H&M Sweden সতর্ক পর্যবেক্ষণ, কম মূল্যে অর্ডার চায়।
PVH (Calvin Klein, Tommy Hilfiger) USA: প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিকল্প উৎস বিবেচনা করছে
BGMEA সূত্র জানায়, বেশ কিছু ব্র্যান্ড এখন sourcing contract পুনর্বিবেচনা করছে।
ফ্যাক্টরির গল্প: অর্ডার কমে গেলে চাকরিই অস্তিত্ব সংকটে
আশুলিয়ার একটি কারখানায় কাজ করেন রায়মনি বেগম। তার কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট:
“গত ৩ মাসে কাজ কমে গেছে। সবাই কেটে দেওয়ার কথা বলছে। কিস্তির টাকা, খাওয়াদাওয়া—সব নিয়ে ভয় লাগতেছে।”
একাধিক গার্মেন্টস মালিক জানিয়েছে, বর্তমানে মার্কিন ক্রেতাদের অর্ডার ৩০–৪০% কমে গেছে, যার ফলে অনেক কারখানায় আংশিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতামত: কেবল ব্যবসা নয়, এটা সামাজিক সংকেত
ড. সেলিম রায়হান, অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:
“এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে শুধু গার্মেন্টস খাত নয়, এতে যুক্ত কোটি নারী বিপন্ন হবে। দেশে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়বে, প্রবৃদ্ধি কমবে।”
তিনি আরও বলেন, “ব্র্যান্ডগুলো এখন শুধু দাম নয়, ঝুঁকি বিবেচনাতেও দেশ নির্বাচন করছে। বাংলাদেশকে এখন ‘রিস্কি সাপ্লাই হাব’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।”
সরকারের ভূমিকা: কূটনৈতিক আলোচনায় সমঝোতার খোঁজ
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ড আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করুক।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু আলোচনায় বসা যথেষ্ট নয় — দরকার জোরালো ট্রেড অ্যাডভোকেসি ও আন্তর্জাতিক লবিং।
করণীয়: সংকট মোকাবেলায় নীতিগত পথনির্দেশনা
মার্কেট ডাইভার্সিফিকেশন: ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার দিকে মনোযোগ
টেকসই উৎপাদন ও অটোমেশন: কম খরচে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন
কূটনৈতিক কৌশল জোরদার: মার্কিন কংগ্রেস ও মিডিয়া পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি
শ্রমিক পুনঃপ্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা: ছাঁটাই শ্রমিকদের বিকল্প খাতে রি-স্কিলিং
বিশেষ ট্রেড ডিল প্রচেষ্টা: GSP সুবিধা পুনর্বহালের কূটনৈতিক তৎপরতা
উপসংহার: সংকট না, সুযোগ?
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শুল্ক বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর নিরব প্রত্যাহার যেন আমাদের ভবিষ্যতের উপর ছায়া ফেলছে। তবে এই সংকট যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায় — তাহলে এটি হতে পারে এক ‘পুনর্জাগরণের’ সূচনা।
এখন দরকার—দৃঢ় কূটনীতি, উৎপাদনের প্রযুক্তিগত রূপান্তর, শ্রমিক সুরক্ষা এবং বাজার বৈচিত্র্য।