জাহিদ ইউ. সৈয়দ
সাভার, ২৮ জুন, ২০২৫
সেদিন সাভারের জিরাবোতে যখন মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন ৮৫ বছর বয়সী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তখন সেখানে উপস্থিত হাজার তরুণ প্রতিনিধি চোখে মুখে আগ্রহ আর সম্ভাবনার আলো নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে। আর তিনি যেন সময়ের উর্ধ্বে দাঁড়িয়ে এক ভবিষ্যতের কল্পনা করছিলেন—একটি পৃথিবী, যেখানে ব্যবসা মানেই শুধুই মুনাফা নয়, বরং সমাজের সমস্যা সমাধানের এক প্রাণবন্ত পথ।
তিনি বললেন,
“তোমরা যারা আজকের তরুণ, তোমরাই পারো এই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে। সামাজিক ব্যবসা তোমাদের হাতিয়ার। শুধু স্বপ্ন দেখবে না, স্বপ্নের জন্য লড়াইও করতে হবে।”
সামাজিক ব্যবসা: তরুণদের জন্য এক বিপ্লবের হাতছানি
‘সোশ্যাল বিজনেস ডে ২০২৫’-এর এবারের থিম ছিল, “সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা সর্বোত্তম পন্থা।” শুনতে হয়তো একটু ভারী লাগতে পারে, কিন্তু ভাবুন তো—গ্রামের একটি কিশোরী যদি এক মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তার মাতার জন্য সাশ্রয়ী চিকিৎসা পায়, তাহলে সেটা কী কেবল প্রযুক্তি? না, ওটাই সামাজিক ব্যবসার সার্থকতা।
এই ফিচার পড়ছেন আপনি যদি একজন তরুণ হন, তাহলে জেনে রাখুন—এই মডেলে আপনি উদ্যোক্তা হতে পারেন, কিন্তু আপনাকে লাভের পেছনে দৌড়াতে হবে না। বরং আপনি একটা সমস্যা খুঁজে বের করবেন, তারপর সেই সমস্যার একটা টেকসই সমাধান দাঁড় করাবেন, যার মুনাফা যাবে সেই সমস্যার সমাধানেই।
তরুণদের পদচারণায় মুখর আন্তর্জাতিক সম্মেলন
এবারের সম্মেলনে বিশ্বের ৩৮টি দেশ থেকে ১,৪০০+ প্রতিনিধি এসেছেন, যার বড় একটি অংশই তরুণ। কেউ এসেছেন আফ্রিকা থেকে জলবায়ু সহনশীল কৃষি নিয়ে কাজ করে, কেউ ল্যাটিন আমেরিকা থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে।
তাদের কারও ভাষা আলাদা, পোশাক আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য এক—মানবিকতা ভিত্তিক নতুন এক ব্যবসা মডেল গড়ে তোলা, যেখানে “giving” আর “earning” একসাথে চলে।
একটি বাস্তব গল্প: সুমাইয়ার হেলথ হাট
সুমাইয়া, নারায়ণগঞ্জের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র ২৪ বছর বয়সে সে একটি সামাজিক ব্যবসা চালু করেছে—“হেলথ হাট” নামে একটি কমিউনিটি ফার্মেসি চেইন, যেখানে দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পায় বিনামূল্যে পরামর্শ ও স্বল্পমূল্যে ওষুধ। মডেলটি এমনভাবে গড়ে তুলেছে যে, লাভ না করলেও ক্ষতিও হয় না, বরং স্থানীয় নার্সরা চাকরি পায়, রোগীরা সেবা পায়।
ড. ইউনূস বললেন,
“সুমাইয়ার মতো তরুণদের হাতেই গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ। তারা স্বপ্ন দেখছে, এবং কাজও করছে।”
কেন সামাজিক ব্যবসা তরুণদের জন্য?
স্বাধীন চিন্তার সুযোগ: নিজের সমস্যা নিজে চিহ্নিত করে সমাধান দাঁড় করানোর সুযোগ।
ইনোভেশনের প্ল্যাটফর্ম: প্রযুক্তি, ডিজিটাল সেবা, কৃষি, ফিনটেক—সবখানেই সম্ভব।
সামাজিক ইমপ্যাক্ট: পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপকার করার ক্ষমতা।
টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের অংশীদার: SDG বাস্তবায়নের হাতিয়ার।
ইউনূসের কণ্ঠে অনুপ্রেরণা
সম্মেলনের শেষদিকে ড. ইউনূস বললেন,
“তোমরা যদি শুধু চাকরির পেছনে ছুটো, তবে তুমি একা এগোবে। কিন্তু সমাজের জন্য কাজ করতে চাও? তবে পুরো পৃথিবী তোমার সঙ্গে এগোবে।”
এই কথাটি শুধু ভাষণ নয়, এটি যেন ভবিষ্যতের আহ্বান।
‘সোশ্যাল বিজনেস ডে ২০২৫’: এক নজরে
স্থান: জিরাবো, সাভার
তারিখ: ২৮-২৯ জুন
প্রতিপাদ্য: “সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা সর্বোত্তম পন্থা”
অংশগ্রহণ: ৩৮ দেশের ১৪০০+ প্রতিনিধি
অতিথি: ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আন্তর্জাতিক কূটনীতিক, নীতি-নির্ধারক ও তরুণ উদ্যোক্তারা
তরুণ সমাজ যদি শুধু লাভের হিসেব না কষে, সমাজের ‘পেইন পয়েন্ট’ খুঁজে তার সমাধান করতে এগিয়ে আসে—তবে যে কেবল বাংলাদেশ নয়, বদলে যেতে পারে পুরো পৃথিবী। আর এই বদলের ভাষা হবে—সামাজিক ব্যবসা।