• হোম > অর্থনীতি | এন্টারপ্রেনার | প্রধান সংবাদ | মধ্যপ্রাচ্য > চলে গেলেন এক কিংবদন্তী উদ্যোক্তা শিকদার গ্রুপের কর্ণধার জেড এইচ শিকদার।

চলে গেলেন এক কিংবদন্তী উদ্যোক্তা শিকদার গ্রুপের কর্ণধার জেড এইচ শিকদার।

  • বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ১৮:২১
  • ১৫২২

জয়নুল হক সিকদার

এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশ ডেস্ক:
সিকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহে রাজিউন)। তিনি বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান।

বুধবার তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে মারা যান।

শিকদার পরিবারের ঘনিষ্ঠজন এবং আমেরিকা প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী জনাব বাবুল ইসলাম এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশকে বিষয়টি  নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, জয়নুল হক বেলা ৩টা নাগাদ বাসাতেই অবস্থানকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃতদেহ দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।

একজন জয়নুল হক শিকদার

কঠিন রাশভারী মানুষ। ৮৭ বছর বয়সেও মাসের ৩০ দিন অফিস করেতেন তিনি। দুপুরের খাবারের পরও বিশ্রাম নিতেন না। দেশ–বিদেশের ব্যবসা সামাল দিতেন নিজেই। সহকর্মীরা বিস্ময় নিয়ে দেখতেন তার কাজের ব্যাপ্তি। কাজপ্রিয় এই মানুষটির নাম জয়নুল হক সিকদার। সবাই তাকে সিকদার সাহেব হিসেবেই জানেন। রেখে গেলেন নিজ হাতে গড়া ব্যাংক–শিল্প–রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধিক মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল।

জয়নুল হকের জন্ম ১৫ মে, ১৯৩৩ সালে, ভারতের আসামে। বাবা মখফর উদ্দিন সিকদার ছিলেন প্রথমে ফরেস্টার, পরে নামজাদা ঠিকাদার। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার। স্কুলে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে ২-১ টাকা থেকে শুরু করে ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত নিতেন। যদিও তখন টাকার মূল্য ছিল বেশ। সে সময় ১ টাকায় এক মণ চাল পাওয়া যেত। এভাবেই জয়নুল হক সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার বাবার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে চুপটি করে কাঠের ব্যবসা শুরু করলেন। কাঠ কিনে এনে নদীর পাড়ে রাখতেন। তারপর ফের সেগুলো খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিতেন। তখন আসামে প্রায়ই মেলা হতো। আর মেলা হলেই চার-পাঁচটি দোকানের সঙ্গে চুক্তি করতেন কিশোর জয়নুল। ‘ব্যবসাটা আমার নেশার মতো লাগত। মেলা এলে চার-পাঁচটি দোকানে লটারির টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করতেন। জিনিস কিনে দিতেন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার। ওই টিকিট বেঁচে বেশ ভালো ইনকাম হতো। যদিও তার বাবা শুনে খুব রাগারাগি করতেন। সে জন্য এক প্রকার চুরি করেই কাজটি করতেন তিনি।’

গ্রামের নাম মধুপুর।শরিয়তপুর জেলার এ গ্রামটিতে রয়েছে ‘মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল’। সিকদার সাহেব নিজ গ্রামে নেমেই প্রথমে বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতেন। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হতেন পাশের গ্রামে। স্ত্রীকে নিয়ে এবার রামভদ্রপুরে স্ত্রীর বাবা-মা অর্থাৎ তার শ্বশুর-শাশুড়ির কবর জিয়ারত করতেন। ‘একসময় এই গ্রামে কোনো পাকা পথঘাট ছিল না। রিকশা-ভ্যান চলত না। যানবাহন বলতে ছিল কেবল লঞ্চ-স্টিমার। বর্ষার দিনে মানুষ জুতা-স্যান্ডেল হাতে নিয়ে চলত। নদী সাঁতরে স্কুলে যেত’।

আজ সেখানে স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। নিজ খরচে পাকা রাস্তাঘাট বানিয়েছেন সিকদার সাহেব। ১৩-১৪টি স্কুল ও অর্ধশতাধিক মসজিদ তৈরিতে অবদান রেখেছেন তিনি। এমনকি তৈরি হয়েছে হেলিকপ্টার ট্রেনিং স্কুল এবং বিমানবন্দর।

প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের ৩ হাজার ৩০০ ফুট লম্বা রানওয়ে আর দুই পাশে লেকের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা চলে যাওয়া যাবে জেড এইচ সিকদার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর একটি দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল। সিকদার গ্রুপের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই এভাবে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায়।
তার বললেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের গল্পটা দারুণ। ‘১৯৪৬ সালে ট্রেনে করে কলকাতা যাচ্ছিলেন তিনি। ওই ট্রেনে বঙ্গবন্ধুও যাচ্ছিলেন। তখন তাকে চিনি না। একজন সাদা পোশাকে এসে আমাকে সার্চ করল। আমি বললাম, আপনি পুলিশ না, কিছু না, কিন্তু এমন করছেন কেন। সে বলল, এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। পরে একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, কার জন্য এমন ব্যবস্থা? তিনি কে? উত্তরে লোকটি বলল, তিনি শেখ মুজিব। সেই প্রথম মুজিব ভাইকে দেখলাম। এরপর ১৯৫০ সালে একটি কাজে আতাউর রহমানের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে ভাসানী সাহেবও ছিলেন। আর তাদের সঙ্গে বসে আলাপ করছিলেন শেখ সাহেব। আমাকে দেখে হাসলেন। পরিচিত হলেন। বললেন, আমরা আওয়ামী লীগ গঠন করছি। আমি বললাম, এটি আবার কোন লীগ? এর পর থেকে আস্তে আস্তে মুজিব ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হলো। ’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছেন জয়নুল হক। প্রায় ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। গড়ে তুলেছিলেন আক্কাস বাহিনী। এ বাহিনীর রহস্য, ‘আক্কাস নামে এখানে একটি ছেলে ছিল যে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। তার নামেই এ বাহিনীর নামকরণ করা। আমাদের আন্ডারে চারটি থানা ছিল। পরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষভাবেই যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। আগস্টের দিকেই শরীয়তপুর স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। ’

বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয় না, আছে ব্যবসায় শিক্ষা, ইংরেজি ও আইন বিভাগও। মোট ৭টি বিভাগে এখানে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০০। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীসহ অন্তত আড়াইশ’ শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ বিনা খরচে পড়ালেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন। সাগর মণ্ডল নামে ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘গ্রামে বসে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারব কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। ’

বৃদ্ধাশ্রম দেখতে যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, টেনিস গ্রাউন্ড, কমার্শিয়াল চাইনিজ রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামো চোখে পড়বে। সিকদার সাহেব সুন্দর এ গ্রামটিতে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলছেন একটি বৃদ্ধাশ্রম। আশ্রমের সামনে শান বাঁধানো ঘাট, আর স্বচ্ছ পানির পুকুর। বৃদ্ধাশ্রমের মানুষ এখানে গোসল কিংবা বিকালে বসে গল্প করতে পারবেন।

‘পল্লীকুঠি’র দিকে। পথে যেতে যেতে একটি বিশাল বর্গাকৃতি লেকে স্বচ্ছ পানিতে চোখ আটকে যায়। শান বাঁধানো ঘাট। লেকের পানিতে ভাসে কারুকার্যখচিত ময়ূরপঙ্খি নৌকা। আর লেকের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন গ্লাস হাউস। হাউসের ওপর হেলিপ্যাড। সিকদার সাহেব তার পরিবারকে নিয়ে জল-জোছনা উপভোগের জন্যই এ আয়োজন করছিলেন। লেকের বিপরীতেই শৈল্পিক রুচিতে তৈরি করেছেন দোতলা ‘পল্লীকুঠি’র। পারিবারিক এ রিসোর্টটি দেখতে বিকালে ভিড় জমান আশপাশের গ্রামের শত শত মানুষ।

কেরানীগঞ্জে সিকদার গ্রুপের ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টটি না দেখলে অনেক কিছুই মিস হবে। জামালগঞ্জেও কোম্পানির এমন আরেকটি পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে। খুলনায়ও তৈরি হচ্ছে আরেকটি প্লান্ট। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জে বর্তমান প্লান্টটির পাশেই আরও একটি ১৫০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট তৈরির প্রস্তুতি চলছে। সিকদার সাহেব পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশের। বরিশাল, ভাগ্যকুল, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দাদার ৭-৮টি তালুক (জমিদারি) ছিল। দাদা একদিন ভাগ্যকুলের এক জমিদারের কাছে ৫ হাজার টাকায় একটি তালুক বেচে দিলেন। সে টাকা নিয়ে স্টিমারে করে আসাম চলে গেলেন। সেখানে অভয়পুরের মহারাজাকে ২ টাকা নজরানা দিয়ে ২ হাজার বিঘা জমি পেলেন। শুরু করলেন ফরেস্ট্রির ব্যবসা। বাবাকে ফরেস্টার বানালেন। যদিও কিছু দিন পর বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। বিরাট ঠিকাদার হয়ে গেলেন। তখনকার দিনে ১৯৩৪-৩৫ সালের মধ্যেই বাবার ২-৩ কোটি টাকা জমে গেল। আসামের মধ্যে তিনি এক প্রকার ধনী হয়ে গেলেন। এমন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারেই জন্ম তার। ’

ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন তিনি। তখন তাকে সবাই ঝুনু নামে ডাকত। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় মন ছিল না তার। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক ব্রিটিশ পুলিশ পেটানোর মধ্য দিয়েই সবার কাছে এক নামে হয়ে গেলেন ‘ঝুনু ভাই’। তখন ১ টাকায় আধ মণ বাদাম পাওয়া যেত। ‘ঝুনু ভাই’ নেতা হিসেবে প্রতিদিন বিকালে ১ টাকার বাদাম কিনে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসতেন। আর লোকজনকে খাইয়ে খুশি রাখতেন। এরপর এক বাঙালি স্কুলে আগুন দেওয়ার ঘটনায় বাবা এবার তার ছেলেকে পড়ালেখা করাতে পাঠালেন আলীগড়ে। সেখানেও এক শিক্ষককে ঘুষি মেরে আউট হয়ে গেলেন জয়নুল হক। জিদ ধরলেন হোস্টেলে থেকে পড়বেন। নিরুপায় হয়ে বাবা তাকে বাড়ির কাছে এক হোস্টেলে রাখলেন। সেখানেও অঘটন ঘটিয়ে পুলিশের হাতে আটক হলেন। এবার তাকে পাঠানো হলো ফরিদপুরে। ১৯৪৮ সালে বরিশাল সেন্টার থেকে পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করলেন। বাবাকে এসে বললেন, ‘রয়েল ডিভিশনে পাস করেন। আমাকে ৫০ হাজার টাকা দাও। বাবা বললেন, হোয়াট? হাউ মাচ?তিনি বললেন, ফিফটি থাউজেন্ট। তিনি বললেন, এত টাকা দিয়ে কী করবা? বললাম, পাকিস্তানে ঢাকার গ্যান্ডারিয়ায় একটা বাড়ি পেয়েছি। তুমি তো নামজাদা মুসলমান। সে কারণে হয়তো ইন্ডিয়ায় আমাদের থাকা হবে না। তাই বাড়িটা কিনে রাখতে চাই। বাবার সাফ কথা— আমি পাকিস্তান-কবরস্তানে যাব না। তুমি ভালো করে পড়াশোনা কর। আমি বললাম, তুমি টাকা দেবে? বললেন, নো। আমি বললাম— ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ, আমি যাচ্ছি। ’

মায়ের ট্রাংক ভেঙে দুটি মোহর, নিজের ক্যামেরা আর হাতের চারটি আংটি নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন জয়নুল হক সিকদার। ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফিতে শখ ছিল। এমনকি ছবি ওয়াশের জন্য নিজেই ডার্ক রুম বানিয়ে নিয়েছিলেন। ঢাকায় এসে চাকরির জন্য ছুটে বেড়ালেন সিকদার সাহেব। প্রথমে গেলেন আমির হোসেন খান নামে এক চাচার কাছে। তিনি ছিলেন পুলিশের আইজি। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হলো আইজি দোহার কাছে। সাব-ইনসপেক্টর পদবিতে চাকরি করতে রাজি হলেন না জয়নুল। গেলেন আর্মিতে। সেখানেও কমিশনে লোক নেওয়ার সময় শেষ। মনের দুঃখে ফিরেই আসছিলেন। কিন্তু শেষ সময় মোহাম্মদ আহমদ নামে এক মেজরের কাছে নিজের ফুটবল খেলার দক্ষতা তুলে ধরে শেষ সুযোগ পেলেন। ‘মেজর বললেন, ফুটবল প্লেয়ার হাম লোগ কো জরুরাত হেই। ’ তারপর বিকালে গ্রাউন্ডে আসতে বললেন। খেলার শুরুতে সেন্টার হাফ থেকে সরাসরি একটি বল মারলেন ঝুনু। শোঁ করে গোলে ঢুকে গেল। ক্যাপ্টেন তাকে ঘাড়ে করে নাচতে শুরু করলেন। পরে রিক্রুট করে নিলেন। কাজ ছিল সকালে-বিকালে দৌড়ানো। আধ সের করে দুধ আর কিশমিশ খাওয়া।

সেখানেও বেশি দিন ভালো থাকতে পারলেন না ঝুনু। খেলার মধ্যে এক ক্যাপ্টেনকে মেরে ফুটবল খেলাও ছেড়ে দিলেন। কিছু দিন পর বাবা এসে হাজির হলেন। ছেলের কথা ছয় মাসের মধ্যেই সত্যি হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে আসাম থেকে বিতাড়িত হয়ে এলেন সিকদার সাহেবের বাবা। ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইলেন। একজন ব্রিগেডিয়ার জয়নুলকে ডাকলেন। বাবার মুখে সব কথা শুনে বললেন, তোমার বয়স অল্প, তারপর আবার বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ। তোমাকে আমরা আর রাখতে পারব না। বাবা বললেন, তুমি ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিলে, আমি তোমাকে ১০ লাখ টাকা দেব। ফিরে চল। জয়নুল হক কোনো কিছুতেই রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার তাকে রেখে দিতে বাধ্য হলেন। বললেন, আপনার ছেলেকে রেখে যান, আগামী বছর তাকে কমিশনে পাঠিয়ে দেব। যদিও শেষ মুহূর্তে ধরাবাঁধা নিয়মের ভয়ে কমিশনে গেলেন না সিকদার সাহেব।

সিকদার সাহেবের ভাষায়— ‘সেই পাকিস্তান আমলে ট্রাকের ব্যবসা শুরু করলাম। প্রথমে চকবাজারে মদিনা ব্রিকস ফ্যাক্টরি থেকে একটি পুরনো ট্রাক ৫ হাজার ১০০ টাকায় কিনলাম। এক বন্ধুর কাছে বউয়ের গহনা বন্ধক রেখে ১ হাজার টাকা পেলাম। বাকিটাও নানা কাহিনী-কেচ্ছা করে জোগাড় হলো। কিন্তু পুরনো ট্রাক বার বার মেরামত করতে করতে সব মিলিয়ে ৮ হাজার টাকা দেনা হলাম। এরপর গাড়ি বিক্রি করে লন্ডন চলে যেতে চাইলাম। শেষ পর্যন্ত একজনের কথায় বেচলাম না। এরপর ওই পাকিস্তান আমলেই চার-পাঁচটি ট্রাক হয়ে গেল। ট্রাকের ব্যবসা আর ঠিকাদারি দুটিই একসঙ্গে চলতে থাকল। মুক্তিযুদ্ধের আগেই গাড়ির পাশাপাশি চারটি বাড়িরও মালিক হলাম। এরপর যুদ্ধ করলাম।

স্বাধীনতার পর প্রথমে না চাইলেও পরে সবার অনুরোধে আবার একই ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু শেখ সাহেবকে মারার পর আর দেশে থাকতে মন চাইল না। চলে গেলেন আমেরিকায়। যে লোকটা দেশ স্বাধীন করেছে তাকে হত্যা করা হয়েছে, এ দেশে থাকবেন না তিনি। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মাধ্যমে ব্যাপক সফলতা পেলেন সিকদার সাহেব। পাশাপাশি কার ওয়াশের ব্যবসা শুরু করলেন। এক-দেড়শ’ মিলিয়নের ১০-১২টি কার ওয়াশ কারখানা হলো তার। আমেরিকা বনাম বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন তিনি।

৮৩-তে ন্যাশনাল ব্যাংকের ডিরেক্টর হলেন। বাংলাদেশেও একে একে ব্যাংক, গার্মেন্ট, রিয়েল স্টেট, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে তারাও সবাই এখন দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বর্তমানে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইউএইউ, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকায় সিকদার গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে। মোটা দাগে রিয়েল এস্টেট, চিকিৎসা ও শিক্ষা, ব্যাংকিং, এভিয়েশন, আবাসিক হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও গার্মেন্ট সেক্টরে তার ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক এবং থাইল্যান্ডের ব্যাংককে সিকদার গ্রুপের কই হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট এখন বিশ্বখ্যাত। সিকদার গ্রুপকে নিয়ে খুলনার মংলায় ২০৫ একর জমির ওপর হচ্ছে দেশের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট ইকোনমিক জোন। এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সিকদার রি-রোলিং মিলস এখন সবার চেনা। বাংলাদেশ আর্মির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বান্দরবানে ২০ একর জমির ওপর হচ্ছে চন্দ্রপাহাড় রিসোর্ট। কক্সবাজারে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিজম ভিলেজ। আবাসন ব্যবসার আওতায় ১০ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে ধানমন্ডিতে হচ্ছে সুবিশাল রিভার প্রজেক্ট। মহাখালীতে হচ্ছে লেক ভিল। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় মংলা পোর্টে নতুন দুটি জেটির দায়িত্বও পেয়েছে কোম্পানিটি।

বাংলাদেশে কীভাবে আরও ব্যবসার সম্প্রসারণ হতে পারে— এ ব্যাপার উনার একটা থিম ছিলো, ‘বাংলাদেশে কিংবা যে কোনো দেশে যে কোনো কাজেই ইফ ইউ ক্যান বি এ গুড অপারেটর, দেন ইউ ক্যান শাইন। ’ তিনি বলেন, ‘আমি আমেরিকায় গিয়ে প্রথম যে ব্যবসা কিনেছিলাম তা ছিল ব্যাংকগ্রাফসি। সেটা নিয়ে প্রচুর খাটতাম। এর পেছনে খেটেই আমি কয়েক বিলিয়ন বানিয়ে ফেলেছিলাম। ’

নতুনদের জন্য তিনি কিছু পরামর্শ রেখে গেছেন—প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক খেটেছি। নিজে হাতে ডেইলি ৬০-৭০টি কার ভ্যাকিউম করেছি। আমেরিকানরা অবাক হয়ে দেখেছে, দোকানের মালিক নিজেই কীভাবে কার ওয়াশ করছে।’ সিকদার সাহেবের আজকের জীবনে সবচেয়ে ভালোলাগার বিষয় ছিলো কাউকে উপকার করতে পারা।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/2403 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 02:35:16 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh