• হোম > প্রধান সংবাদ > পদ্মা সেতু ছিলো আরো একটি মুক্তিযুদ্ধের সুচনা, বিজয়ে মাসে আরো একটি বিজয়।

পদ্মা সেতু ছিলো আরো একটি মুক্তিযুদ্ধের সুচনা, বিজয়ে মাসে আরো একটি বিজয়।

  • শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২০, ২২:৪৭
  • ৮২১

পদ্মা সেতু বিজয়ে মাসে আরো একটি বিজয়।

ড. হারুন রশীদ

আসুন ফিরে যাই ১৯৭১ সালের এই দিনে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তাঞ্চল থেকে একের পর এক খবর আসতে থাকে বিজয়ের। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায় এর মধ্যে। আনুষ্ঠানিক বিজয়ের বাকি আর মাত্র পাঁচ দিন। পাঁচ দশক পরের আজকের ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। হেনরি কিসিঞ্জারদের অবজ্ঞার, তাচ্ছিল্যের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র বাংলাদেশ এক অসাধ্য সাধন করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন করেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্যই নয়, দৃঢ়সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক যেন। কবি সুকান্তের ভাষায়-

‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ

কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,

সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ

জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।

সাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী

অবাক তাকিয়ে রয় :

জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার

তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

সত্যি মাথা নোয়ায়নি বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এতে দেশে এক অভূতপূর্ব জনজাগরণের সৃষ্টি হয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। সবাই ‘যার হাতে যা আছে’ তাই নিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অন্যদিকে মালয়েশিয়াসহ অনেক দাতাগোষ্ঠীও এগিয়ে আসে। সরকার সব পথই খোলা রাখে। এমনকি বিশ্বব্যাংক যেসব কারণ দেখিয়ে ঋণ চুক্তি বাতিল করে, সেগুলোও প্রতিকারের চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন গলেনি বিশ্বব্যাংকের। অবশেষে সম্প্রতি কানাডার আদালতের রায়ে সবকিছু মিথ্যা ও গালগল্প হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় চুক্তি বাতিলের বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তটি যে ভুল ছিল তা স্পষ্ট হয়।

জল অনেক ঘোলা করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছে। পদ্মা সেতুতে ‘মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজবের ডালপালাও গজিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বাধাই স্বপ্নকে আটকে রাখতে পারেনি। মানুষ আসলে তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। পদ্মা সেতু যেন এ সত্যটিকে আরও বেশি করে উদ্ভাসিত করছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ০২ মিনিটে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১তম তথা শেষ স্প্যানটি। আর এর মধ্য দিয়েই দৃশ্যমান হল ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। ডাঙার অংশ ধরলে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য আসলে ৯ কিলোমিটার।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। প্রথম স্প্যান থেকে শুরু করে ৩৯তম স্প্যান বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছরের উপর। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর উপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।

সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করেছিল। একই পথ অনুসরণ করেছিল অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীও। পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্ভাব্য দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয় কানাডার একটি আদালতেও। ইতোমধ্যে সেই মামলার রায়ে আদালত একে নিছকই ‘অনুমান ও গুজব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এবং কানাডার সেই কোম্পানির অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতিও দিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগটি কেবল কিছু ব্যক্তি, সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না; ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও। এ কারণে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয় সরকারকে।

তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরে যেতে হয়। একজন সচিব ও একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং তাদের কিছুদিন কারাবাসও করতে হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেতে কানাডার একটি কোম্পানি ঘুষ দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ব্যাপারে দুই দফা তদন্ত করেও অভিযোগের সত্যতা পায়নি। সরকারও পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়নি বলে জোর দাবি জানালেও কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি বিশ্বব্যাংক।

এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বিরাট দুঃসংবাদ। সরকারও বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সে জন্য ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সরকার। বিএনপি সরকারের সময় যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংককে আবার দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সঙ্গত কারণেই ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে এককভাবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার (৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশের মানুষকে, যদিও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। নানামুখী অসুবিধা ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও পড়তে হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আচরণ ছিল স্পষ্টতই অপেশাদারী। এর পেছনে দেশে-বিদেশে অনেকেই কলকাঠি নেড়েছেন এমন অভিযোগও আছে। স্বপ্নের এই সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। বাংলাদেশ যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে তার প্রমাণ এই সেতু।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা ও দৃঢ়সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক হয়ে থাকবে এটাই আমাদের বিশ্বাস। দেশের সর্ববৃহৎ এ নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা পারি। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত ছিল। এমন বৃহৎ ও খরস্রোতা একটা নদীর উপর এত বড় সেতু নির্মাণ করে আমরা বিশ্বের সামনে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। আমরা বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা যদি সৎ ও অবিচল থাকি তবে আমার যা চাই, তা-ই করতে পারি।’ বাংলাদেশ যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন জাগরণ নিয়ে আসবে।

আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল দেশপ্রেম। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সর্বস্তরের জনতা। ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভূখণ্ড, লাল-সবুজের পতাকা আর জাতীয় সংগীত। দেশপ্রেম থাকলে, সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃঢ়সংকল্প থাকলে পদ্মা সেতুর মতো স্থাপনা সৃষ্টি করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। আমরা মহাকাশে বঙ্গবন্ধুর নামে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা যেন বীর শহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগ ও আত্মদানের কথা কখনও ভুলে না যাই। তবেই সাফল্য আসবে।

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/2342 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 04:49:52 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh