• হোম > এক্সক্লুসিভ | ফিচার > আম্রপালী -রাষ্ট্র যাকে বানিয়েছে নগরবধু

আম্রপালী -রাষ্ট্র যাকে বানিয়েছে নগরবধু

  • শুক্রবার, ১০ জুলাই ২০২০, ০৫:৫২
  • ১৪৬৬

আম্রপালী

জালাল উদ্দিন আহমেদ

স্বাদের দিক থেকে অনেকের কাছেই আম্রপালী আম খুবই প্রিয় । ছোট কিন্তু মিষ্টির দিক থেকে যেন সকল আমকে পিছনে ফেলে দিয়েছে আম্রপালী । কিন্তু জানেন কি এই আমটার নাম করণ কোথা থেকে হলো ?আজকে সেই আম্রপালীর ইতিহাসটাই তুলে ধরবো

আম্রপালী -যে জন্মেছিলো আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে ভারতে ,সে ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এবং নর্তকী । যার রুপে পাগল ছিলো পুরো দুনিয়া । আর এই রুপই তার জন্য কাল হয়ে উঠে যার কারণে সে ছিলো ইতিহাসের এমন একজন নারী যাকে রাষ্ট্রীয় আদেশে পতিতা বানানো হয়েছিলো !!! আম্রপালী বাস করতেন বৈশালী শহরে । বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিক একটি শহর যেটি বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের অর্ন্তগত । মাহানামন নামে এক ব্যক্তি শিশুকালে আম্রপালীকে আম গাছের নীচে খুঁজে পায় তার আসল বাবা মা কে ইতিহাস ঘেটেও তা জানা যায়নি । যেহেতু তাকে আম গাছের নীচে পায় তাই তার নাম রাখে আম্রপালী । সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পল্লব হল পাতা | অর্থাৎ আমগাছের নবীন পাতা । কিন্তু শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পা দিতেই আম্রপালীকে নিয়ে হইচই পড়ে যায় তার রুপে চারপাশের সব মানুষ পাগল হয়ে যায় দেশ বিদেশের রাজপুত্র রাজা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তার জন্য পাগলপ্রায় ; বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ে দ্বন্ধ ঝগড়া বিবাদের খবরও আসতে থাকে সবাই তাকে একনজর দেখতে চায় বিয়ে করতে চায় । এ নিয়ে আম্রপালীর মা বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন ।

তারা তখন বৈশালীতে সকল গণমান্য ব্যক্তিকে এর একটি সমাধান করার জন্য বলেন কারণ সবাই আম্রপালীকে বিয়ে করতে চায় । তখন বৈশালীর সকল ক্ষমতাবান ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা ছিলো ঐতিহাসিক, সেটা ছিলো আম্রপালীকে কেউ বিয়ে করতে পারবেনা কারণ তার যে রুপ সে একা কারো হতে পারেনা । আম্রপালী হবে সবার সে হবে একজন নগরবধু মানে সোজা বাংলায় পতিতা । এটা ছিলো একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত , ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত খুবই বিরল !!

আম্রপালী সে সভায় ৫টি শর্ত রাখেন

আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(১) নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তার ঘর হবে
(২) তাঁর মুল্য হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(৩) একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে পারবেন
(৪ ) শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে প্রয়োজনে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার তার গৃহে প্রবেশ করা যাবে
(৫) তার গৃহে কে আসলো গেলো এ নিয়ে কোন অনুসন্ধান করা যাবেনা ।

সবাই তার এসব শর্ত মেনে নেয় ।

এভাবে দিনে দিনে আম্রপালী বিপুল ধন সম্পদের মালিক হয়ে উঠেন । এদিকে আম্রপালীর রুপের কথাও দেশ বিদেশে আরও বেশি করে ছড়াতে থাকে । প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার । শুনা যায় তার স্ত্রীর সংখ্যা নাকি ৫০০ ছিলো । নর্তকীদের নাচের এক অনুষ্ঠানে বিম্বিসার এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন এ নর্তকী বিশ্বসেরা তখন তার এক সভাসদ বলেন মহারাজ এই নর্তকী আম্রপালীর নখেরও যোগ্যও নয় !! বিম্বিসারের এক কথাটি নজর এড়ায়নি সে তার সভাসদ থেকে আম্রপালী সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাবার বাসনা করে কিন্তু তার সভাসদ বলেন সেটা সম্ভব নয় কারণ তাহলে আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে আর আম্রপালীর দেখা পাওয়াও এত সহজ নয় । দেশ বিদেশের বহু রাজা রাজপুত্র আম্রপালীর প্রাসাদের সামনে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কিন্তু মন না চাইলে সে কাউকে দেখা দেয়না । রাজা বিম্বিসার এত কথা শুনে তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেলো সে সিদ্ধান্ত নিলো ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালীকে দেখে আসবে, কি এমন নারী যার জন্য পুরো জাহান পাগল হয়ে আছে ! তারপর বহু চড়াই উৎরাই এর পড়ে রাজার আম্রপালীর সাথে দেখা করার সুযোগ আসে আম্রপালীর প্রাসাদ আম্রকুন্জে কিন্তু দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে উঠেন, এতো কোন নারী নয় যেন সাক্ষাৎ পরী এ কোনভাবেই মানুষ হতে পারেনা, এত সুন্দর এত রুপ মানুষের কিভাবে হতে পারে !!!!

কিন্তু অবাক রাজার জন্য আরও অবাক কিছু অপেক্ষা করছিল কারণ আম্রপালী প্রথম দেখাতেই তাকে সে যে মগধ রাজ্যের রাজা বিম্বিসার তা ধরে ফেলে এবং আম্রপালী জানায় সে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বহু আগে থেকেই !! এ কথা শুনে রাজার বিস্ময়ের আর বাকী থাকেনা । রাজে সাথে সাথে তাকে তার রাজ্যের রাজরাণী বানানোর প্রস্তাব দেয় কিন্তু আম্রপালী জানে তার রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নিবেনা উল্টো বহু মানুষের জীবন যাবে রক্তপাত হবে তাই তাকে দ্রত এখান থেকে চলে যেতে বলে ! রাজা বিম্বিসার বৈশালী আক্রমন করে আম্রপালীকে পেতে চান কিন্তু আম্রপালী তার নিজের রাজ্যের কোন ক্ষতি চাননা তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান এবং বৈশালীতে কোন আক্রমণ হলে তিনি তা মেনে নিবেন না তাও সাফ জানিয়ে দেন । এদিকে বিম্বিসার এর সন্তান অজাতশত্রু যে নিজেও আম্রপালীর প্রেমে মগ্ন ছিলেন সে বিসিম্বরকে আটক করে নিজে সংহাসন দখল করে বসেন এবং আম্রপালীকে পাওয়ার জন্য বৈশালীতে আক্রমণ করে বসেন কিন্তু দখল করতে সক্ষম হননি এবং খুব বাজেভাবে আহত হন । পরবর্তীতে আম্রপালীর সেবায় সে সুস্হ হয়ে গোপনে তার নিজের রাজ্যে ফেরত যান । সেদিনও আম্রপালী অজাতশত্রুর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ।

এত নাটকীয়তার পর শেষের দিকে এসে কি হলো ?

গৌতম বুদ্ধর সময়কাল তখন, গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশো সঙ্গি নিয়ে বৈশালী রাজ্যে এলেন । একদিন বৈশালী রাজ্যের রাবান্দা থেকে এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে তার মনে ধরে গেলো আম্রপালী ভাবলো দেশ বিদেশের রাজারা আমার পায়ের কাছে এসে বসে থাকে আর এতো সামান্য একজন মানুষ । সে সন্ন্যাসীকে ৪মাস বর্ষাকাল তার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে বললেন, সবাই ভাবলো কখনোই রাজি হবেনা কারণ একজন সন্ন্যাসী এমন একজন পতিতার কাছে থাকবে এটা হতেই পারেনা কিন্তু গৌতম বুদ্ধ সেদিন তাকে রাখতে রাজি হলো এবং এটাও বললো আমি শ্রমণের (তরুণ সে সন্ন্যাসীর নাম ছিলো ) চোখে কোন কামনা বাসনা দেখছিনা সে চারমাস থাকলেও সে নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি নিশ্চিত ।

চার মাস শেষ গৌতম বুদ্ধ তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাবেন !! তরুণ শ্রমণের কোন খবর নেই তবে কি আম্রপালীর রুপের কাছেই হেরে গেলো শ্রমণ ? সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন তার পিছনে পিছনে আসেন একজন নারী ; সেই নারীই ছিলেন আম্রপালী !! তিনি বলেন , তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি | কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী | আজ, সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান আম্রপালী !!! সব কিছু দান করে তিনি বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত এই রমণী আম্রপালী ।

আর এই আম্রপালী নারীর নামেই ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশোহরি ও নিলাম-এই দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন আম্রপালী।

সূত্র: জনসংযোগ

Bangladesh Friendship Journalism Association


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/2068 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 05:00:53 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh