• হোম > অর্থনীতি > দুশ্চিন্তায় খামারিরা, কি হবে এবার

দুশ্চিন্তায় খামারিরা, কি হবে এবার

  • শনিবার, ৪ জুলাই ২০২০, ০৫:৫৯
  • ৮৫৭

গরু পালন

অমিতোষ পাল

করোনার কারণে শঙ্কা রয়েছে অনেক। তারপরও রাজশাহীর একটি খামারে কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য পালন করা হচ্ছে গরু

ঈদুল আজহায় ১৪টি কোরবানির পশুহাট বসাতে গত ১৭ জুন দরপত্র আহ্বান করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু নির্ধারিত সময় গত ২৯ জুন পর্যন্ত তিনটি হাটের বিপরীতে দরপত্রই জমা পড়েনি। দুটি হাটের বিপরীতে দর উঠেছে; তবে তা সরকার নির্ধারিত ইজারামূল্যের চেয়ে অনেক কম। একই অবস্থা অন্য হাটগুলোতেও। দরপত্রও জমা পড়েছে অনেক কম। অথচ প্রতিবারই প্রায় প্রত্যেক হাটের বিপরীতেই দর ওঠে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি, প্রতিযোগীও থাকে বেশি।

হাট ইজারার নাজুক এই চিত্র শুধু ডিএসসিসিতেই নয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০টি হাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এমনকি সারাদেশের চিত্রও তাই। আর এমন অবস্থার কারণ করোনাজনিত পরিস্থিতি।

কয়েক গুণ কমবে পশু কোরবানি : অন্যান্য বছর মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ঈদুল আজহা পালন করতেন। করোনার কারণে এবার সেরকম হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এখন আর্থিকভাবে সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। তারা এবার পশু কোরবানির কথা ভাবতেই পারছেন না। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যারা একাধিক পশু কোরবানি দিতেন, তারাও এবার পশুসংখ্যা কমাবেন। অনেকেই এবার করোনাজনিত কারণে পশুহাটে যেতে অনাগ্রহী। সব মিলিয়ে এবার পশুর চাহিদা থাকবে কম। সঙ্গত কারণেই এবার সারাদেশে পশুহাটের সংখ্যা কমেছে। আগ্রহী ইজারাদাররা হাটের ইজারামূল্যও কমিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউটিউবার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান আজিম সমকালকে বলেন, গত বছর কোরবানির পশুহাটগুলোতে প্রচুর গরু অবিক্রীত ছিল। এবার আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না। কারণ, অনেকে এখন চাকরিহীন, নিম্নবিত্তরাও কর্মহীন। যারা আট-দশটা পশু কোরবানি দিতেন, তারা দু-তিনটা দেবেন। অনেকে কোরবানির জন্য বাজেট কমাবেন। এ কারণে গরুর বদলে খাসির বাজার ভালো যাবে।

পশুর মজুদ পর্যাপ্ত :প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ধারণা করা হয়েছিল এবার এক কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হবে। এর মধ্যে গরু হবে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। এ জন্য দেশে পশু মজুদ আছে এক কোটি ২৫ লাখ। এর মধ্যে গরু ৫০ লাখ। কাজেই ভারতীয় গরুর ওপরও নির্ভর করতে হবে না। আর সরকার কয়েক বছর থেকেই দেশীয় খামারিদের উৎসাহিত করতে ভারতীয় পশু আমদানি বন্ধ রেখেছে। ফলে খামারিরাও ভালো দাম পাচ্ছেন। এ অবস্থায় এবারও ভারতীয় গরু আমদানি করার মোটেই সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পশুসম্পদে স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। মাংসের চাহিদার পুরোটাই দেশীয় পশুতে মিটছে।

উদ্বেগে খামারিরা :দেশে করোনাভাইরাস ও পর্যাপ্ত পশুমজুদের কারণে উদ্বেগে পড়েছেন খামারিরা। অন্যান্য বছর কোরবানির কয়েক মাস আগে থেকেই ফড়িয়ারা খামারিদের পেছনে ঘুরতে শুরু করতেন। এবার কোরবানির মাত্র মাসখানেকেরও কম সময় বাকি থাকলেও কোনো ফড়িয়া বা আগাম ক্রেতার দেখা মিলছে না খামারে।

নাটোরের খামারি রমজান আলী বলেন, ‘এখন বাজার খুবই খারাপ। আমার নিজের পালন করা গরু আছে ১৭টি। ১৫ মণ করে শুধু মাংসের ওজন হবে- এমন গরু আছে তিনটি। সাড়ে সাত লাখ টাকায় এই তিনটি গরু গত কোরবানির এক মাস আগে কিনেছিলেন তিনি। প্রতিটি গরু এবার ৬-৭ লাখ টাকায় বিক্রির আশা ছিল। কিন্তু কোনো পার্টি মিলছে না।’
পাবনার সাথিয়া উপজেলার আফড়া গ্রামের খামারি শাজাহান আলী বলেন, ‘এবার কপালে যে কী আছে, তা বুঝবার পারতিচি না। এহন পর্যন্ত বাড়িতে একজন ব্যাপারীও গরু দেখবার আসে নাই, হাটেও গরুর দাম নাই। গরু বেচবার পারবোনে কিনা, হেই চিন্তায় ঘুম আসে না। গরু তো আর না খাইয়ে রাহা যায় না, ৩০টা গরু পালতে কয়েক লাখ টাহা খরচ হচ্ছে। দুই মাস হইছে রাখালদের বেতনও দেই নাই। গরু বেচবার না পারলি খুব মুশকিলে পড়ে যাব।’ গরুর দালালরাও গরু কিনতে খামারিদের কাছে ব্যাপারীদের নিয়ে আসছেন না বলে জানান খামারিরা।
অবশ্য কয়েকজন ব্যাপারী বলেন, এবার তারা অনলাইনে পশু বিক্রির চেষ্টা করবেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিক অ্যাগ্রো লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন সমকালকে বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম খুব বড় নয়। অনলাইনে কেনাকাটা চলে বড়জোর ৫ শতাংশ। এবার হয়তো সেটা বড়জোর ১০ শতাংশ হতে পারে। তার বেশি নয়। যে খামারি মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা কিংবা সৈয়দপুর থেকে হাটে গরু আনেন, তিনি তো অনলাইনে পশু বিক্রি বোঝেন না। এ রকম খামারিই বেশি। অনলাইনে বিক্রি করে ঢাকার আশপাশের হাতেগোনা কয়েকটি খামারি প্রতিষ্ঠান। গত বছর মোট ৪৫ লাখ গরু বিক্রি হয়েছে- যার মধ্যে ২৫ লাখ ঢাকায়। কিন্তু ২৫ লাখ গরু অনলাইনে কীভাবে বিক্রি করবেন? অনলাইনে বড়জোর ১০ হাজার গরু বিক্রি হবে।’

হাটে পশু-ক্রেতা দুইই কম থাকবে :করোনাভাইরাস ও সাধারণ মানুষের পকেটে টাকা না থাকার কারণে এবার সারাদেশের পশুহাটগুলোতে পশুও কম থাকবে। সেই সঙ্গে ক্রেতাও কম থাকবে। কারণ, করোনার কারণে অনেক ক্রেতা-বিক্রেতা হাটে যাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। আবার আর্থিক অক্ষমতার করণে পশু কেনার চিন্তাই করবেন না অনেকে।

বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউটিউবার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান আজিম বলেন, করোনার কারণে এবার বড় খামারিরা ৬০ শতাংশ পশু হাটে তুলতে পারবেন। আর ছোট খামারিরা তো অর্থ সংকটে পড়ে গত রমজানেই পশু বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক ছোট খামারির কাছে গরুই নেই। ভারতীয় গরুও আসছে না। কাজেই এবার ক্রেতাও কম, গরুও কম। এতে বাজারে ভারসাম্য থাকতে পারে। কিন্তু হাটে গরুর সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে বাংলাদেশের খামারিরা বিপদে পড়বেন। কারণ, গত তিন মাসে খামারিদের খাবার কিনতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

সাদিক অ্যাগ্রো লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন জানান, গত বছর এক হাজার ৪০০ পশু বিক্রি করেছিলেন তিনি। এবার টার্গেট এক হাজার ৮০০টি গরু বিক্রির। কিন্তু হবে কিনা সন্দেহ।
রাজধানীর পশুহাটের চিত্র নাজুক :পশুহাটের ইজারা নেওয়া নিয়ে বরাবরই একটি প্রতিযোগিতা ও মহড়া হয় নগরভবনে। কিন্তু এবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো নগরভবনেই সে চিত্র পাওয়া যায়নি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শ্যামপুর বালুর মাঠ-সংলগ্ন হাটটিতে সরকার নির্ধারিত দর ছিল এক কোটি দুই লাখ ১১ হাজার টাকা। হাটটির ইজারা নিতে কেউ দরপত্রই জমা দেননি। একই অবস্থা দনিয়া কলেজ মাঠ-সংলগ্ন খালি জায়গার মাঠ ও ধূপখোলা মাঠ-সংলগ্ন খালি জায়গার মাঠটি। অথচ এ তিনটি হাট ইজারা নেওয়ার জন্য এলাকাবাসীর মধ্যে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা চলে। বরাবরই সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দরও ওঠে।

মেরাদিয়া বাজার-সংলগ্ন খালি জায়গা ও আরমানিটোলা মাঠ-সংলগ্ন খালি জায়গার মাঠটির বিপরীতেও সরকার নির্ধারিত দরও ওঠেনি। অথচ প্রতিবারই সরকার নির্ধারিত দরের দুই থেকে তিনগুণ দাম ওঠে। মেরাদিয়ার সরকার নির্ধারিত দর এক কোটি নয় লাখ ৩৯ হাজার টাকার বিপরীতে দর উঠেছে ৯০ লাখ ও আরমানিটোলার সরকারি দর এক কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিপরীতে দর উঠেছে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি পশুর হাটের মধ্যে পাঁচটিরই ভয়াবহ দরপতন হয়েছে। কয়েকটি হাটের ক্ষেত্রে দর পাঁচগুণ নেমে গেছে। দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করেও কাঙ্ক্ষিত দর পায়নি করপোরেশন। দর কম ওঠার কারণে প্রথম দফায় মাত্র চারটি হাটের ইজারা সম্পন্ন করতে পারে কর্তৃপক্ষ। তবে সেগুলোও গত বছরগুলোর চেয়ে অনেক কম মূল্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
কয়েকটি মাঠের ক্ষে০ত্রে কাঙ্ক্ষিত দরপত্র জমা পড়েনি। তেজগাঁও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠের হাটের জন্য মাত্র একটি দরপত্র জমা পড়ে। হাটটির সরকারি ইজারামূল্য ৪৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ টাকা। দর ওঠে মাত্র ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ভাটারা (সাঈদনগর) পশুর হাটের জন্য তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। হাটটির সরকারি ইজারামূল্য এক কোটি ৭৪ লাখ এক হাজার ৬৬৭ টাকা। অথচ সর্বোচ্চ দর ওঠে ৭১ লাখ টাকা। অন্য বেশ কয়েকটি হাটের ক্ষেত্রেও একই চিত্র বিদ্যমান। সব ক্ষেত্রেই কারণ একটাই। ইজারাদাররাও মনে করছেন, এবার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই কম হবে পশুহাটে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, এবার দরপত্র ও ইজারামূল্য দুটোই কম পড়েছে। এ কারণে কয়েকটি হাটের তারা ইজারা চূড়ান্ত করতে পারেননি। বিষয়টি মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়ায় আগে জনস্বার্থ বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হবে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে হাটের সংখ্যা কমাতে হতে পারে, বাড়ানোর প্রয়োজন হলে বাড়ানো হবে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আয় মূল বিষয় নয়- মুখ্য বিষয় হলো নাগরিকদের স্বার্থ।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম থেকে শৈবাল আচার্য্য, রাজশাহী থেকে সৌরভ হাবিব, পাবনা থেকে এ বি এম ফজলুর রহমান, সিরাজগঞ্জ থেকে আমিনুল ইসলাম খান রানা, উল্লাপাড়া থেকে কল্যাণ ভৌমিক এবং শাহজাদপুর থেকে কোরবান আলী লাভলু)

সূত্র: সমকাল


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/2017 ,   Print Date & Time: Friday, 6 June 2025, 06:31:22 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh