• হোম > প্রধান সংবাদ | ফিচার | বিদেশ > ব্যাবসা বাঁঁচলে বাঁঁচবে অর্থনীতি, বাঁঁচবে দেশ। এখনই সময় সমন্বিত প্রয়াস এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার।

ব্যাবসা বাঁঁচলে বাঁঁচবে অর্থনীতি, বাঁঁচবে দেশ। এখনই সময় সমন্বিত প্রয়াস এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার।

  • বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২০, ০৩:১৯
  • ১৩৩৪

ঢাকা সিটি

কামরুজ্জামান

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে।

অনেকের মতে সরকারকে অর্থনৈতিক সহায়তার বদলে অনেক বেশি নীতি সহায়তার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সাহায্য করতে হবে।তবে শুধু নীতি সহায়তা যে কাজে দিবে না তা দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কিম্বা অন্যান্য ব্যবাসীদের কথায় স্পষ্ট বোঝা যায়।

অবশ্য ইতি মধ্যে করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার বন্টন ব্যবস্থার স্বচ্ছতার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

ছোট ও মাঝারী উদ্যোক্তা :

দেশে করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে থমকে গেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানো এসব উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে নীতি নির্ধারকদের। প্রয়োজন মতো সরবরাহ করতে হবে সহজ শর্তের ঋণ।

১৬ থেকে ৩শ’ জনের কম কর্মীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা অনু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আওতায় পড়ে। বাংলাদেশের মোট শিল্পের ৯৩ শতাংশই এমন ধরনের উদ্যোগ। এসব শিল্প মূলত স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন পণ্য সরবার করে, পাশাপাশি রপ্তানীতেও কিছুটা ভূমিকা রাখে। পুঁজি কম এবং সঞ্চয় সীমিত হওয়ায় উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষমতাও কম । তাই করোনা বিপর্যয়ে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ায় মারাত্মক হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো।

ট্রেডিং,পাইকারী ও খুচরা ব্যবসা:

এক পরিসংখ্যানে জান যায়, দেশে ক্ষুদ্র পাইকারী ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাদের কর্মচারী ১৫ জনের নিচে এমন সংখ্যা ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৭১৬টি প্রতিষ্ঠান। যা দেশের মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৩৯ ভাগ। পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ৮৫ ভাগ। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট কর্মচারীর সংখ্যা ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৯২৯ জন। তাদের প্রতি মাসে বেতন ১৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ট্রান্সপোর্টসহ ক্ষুদ্র পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা জিডিপিতে ২৪ দশমিক ৬০ ভাগ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি জানিয়েছে, সাধারণ ছুটিতে কেনাবেচা বন্ধ থাকায় তাদের দোকানগুলোর দিনে ক্ষতি হচ্ছে ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। তারা এ হিসাব করেছে একেকটি দোকানে গড়ে ২০ হাজার টাকা বিক্রি ধরে। আর লভ্যাংশ ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ।

এ হিসাব দিয়ে দোকান মালিক সমিতি কর্মচারীদের বেতন দিতে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, রপ্তানি খাতে মজুরি ও বেতন দিতে যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, তারাও আংশিক সহায়তা হিসেবে একই ধরনের তহবিল চায়।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এজন্য ব্যাংকগুলো সময়মতো ঋণের কিস্তির টাকা পাবে কিনা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি ব্যাংকগুলো সদয় থাকবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি’র চেয়ারম্যান এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার।

তিনি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি চলছে তাতে মনে হচ্ছে, করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা হয়তো আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়বেন। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা ক্ষতির মুখে পড়বেন ব্যাংকগুলো তাদের পাশে দাঁড়াবে।’

কথা হচ্ছিলো আলহাজ্ব আব্দুস সালামের সাথে। তিনি বাংলাদেশ সেনিটারী ইমপেক্স ও এগ্রো মেশিনারী এন্ড স্পেয়ার্স এর স্বত্বাধিকারী। সিদ্দিক বাজারের আয়েশা প্লাজায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। তিনি একজন আমদানীকারক ও পাইকারি ব্যাবসায়ী।
কমিটমেন্ট ও সততা যার ব্যবসার মূলমন্ত্র। কথা বলেন যথেষ্ট হিসাব করে। ব্যাবসায়ী হিসাবেও অভিজ্ঞতা রাখেন যথেষ্ট। তিনি বলেন, পন্য আমদানির পর ওয়ার হাউজে পড়ে আছে। লকডাউনের ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ, সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হবার কারণে চাহিদা থাকার পরও খুচরা বিক্রেতাদের কাছ পন্য পাঠাতে পারছেন না।

গোডাউন এ পড়ে থাকা পন্য দুই ভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে,
প্রথমত কিছু পন্য গুনগত মান হারাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত এলসির মাধ্যমে আমদানি করা পন্যের প্রতিদিনই ইন্টারেস্ট যোগ হচ্ছে। যা ব্যবসায়ীদের উপর বোঝার মত চেপে বসছে।

তিনি বলছে, তার মত অনেক আমদানিকারকের সরকারের কাছে চাওয়া, এই ব্যাংক ইন্টারেস্ট ম‌ওকুফ । তাতে করে হাজার হাজার আমদানিকারক ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে।

মফস্বলের ব্যবসায়ীদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরবরাহ লাইন বন্ধ থাকার কারনে রিমোট এরিয়াতে তাদের মজুদকৃত অনেক পন্য শেষের পথে। বিশেষ করে কৃষি যন্ত্রাংশের স্পেয়ার পার্টস, পাম্প, স্যালো মেশিন ইত্যাদি। এগুলি জরুরী পন্যের তালিকাভুক্ত। উদাহরণ দিতে যেয়ে তিনি বলেন, কালিগঞ্জ একজন কৃষক থাকেন তার বাড়ি টিউবওয়েল বসাতে চাই কিম্বা এখন নতুন ধান উঠার পর নতুন করে ধান রোপন করতে সেচ দিতে হবে। সেচ যন্ত্রের জন্য একটা বিয়ারিং দরকার কিম্বা টিউবওয়েল কিনবেন, এটির সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে কৃষক এটি কিনতে পারছে না এবং তিনি ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

নবাবপুর, সিদ্দিক বাজার এবং আলুবাজার মূলত এসবের আমদানিকারক ও হোলসেলার। তাদের চাওয়া সপ্তাহে অন্তত দুইদিন পর্যায়ক্রমে ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা । নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে যদি ঢাকার বাইরে প্রয়োজনীয় মাল সামগ্রী ডেলিভারি দেয়া যায় তাহলে ব্যবাসীরা স্থায়ী ক্ষতির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন এবং রিমোট এরিয়াতে কৃষক তথা অন্যান্যরা উপকৃত হবেন বলে তিনি মনে করছেন করছেন।

করোনা প্রাদুর্ভাবের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি খাতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রাথমিক হিসাব বলছে, আমদানি-রফতানি সংকচিত হওয়া কয়েকটি খাতে অন্তত ৬০০০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে কাঁচামালের অভাবে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার উৎপাদন সংকচিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

একইভাবে কমে আসছে আমদানি নির্ভর পণ্যের সরবরাহ। বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন বলছে, ভবিষ্যতে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।

করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে ইতোমধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি। নতুন করে এলসি খোলা তো হচ্ছেই না, আগের করা এলসি পণ্যের জাহাজিকরণও বন্ধ। বন্ধ রয়েছে ব্যবসায়ী এবং কর্মরতদের আসা-যাওয়াও।

করোনা ভাইরাসের কারণে গত দেড় মাসে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে এক ধরণের ধাক্কা লেগেছে।

তার একটি বড় কারণ বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে।

এছাড়া অনেক খাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানির সিংহভাগ আসে চীন থেকে, আবার সেদেশে রপ্তানিও হয় বেশ কিছু পণ্য।

গত অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ১ হাজার ৩৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর রপ্তানি করেছে ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য।

কোন খাতে কত ক্ষতির আশংকা

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সরকারকে এক রিপোর্ট পাঠিয়েছে, তাতে মোট ক্ষতির কোন পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি।

তবে, তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ শিল্প এবং ইলেক্ট্রনিক্সসহ মোট ১৪টি খাত চিহ্নিত করে বলা হয়েছে চীনের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি উভয় খাতে আর্থিক ক্ষতির আশংকা রয়েছে।

যেসব খাত কমিশন চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি দুই-ই রয়েছে।

সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোঃ আবু রায়হান আলবেরুনী বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন কোন খাতে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বাণিজ্য হয়ে থাকে।

কোন খাতে কেমন ক্ষতির আশংকা তাদের রয়েছে তা নিয়ে বলছিলেন মিঃ আলবেরুনী -

* তৈরি পোশাকের মধ্যে নিট খাতের ডাইং ও কেমিক্যাল এবং অন্যান্য অ্যাক্সেসরিজের ৮০-৮৫ শতাংশ আমদানি নির্ভর এবং সেগুলো চীন থেকে আসে। এর বাইরে ওভেন খাতের ৬০ শতাংশ আসে চীন থেকে।

* গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ, প্যাকেজিং খাতে চার বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল দরকার হয়, এ খাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে।

* ভোগ্যপণ্যের মধ্যে ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন রসুন, আদা, লবণ, মসুর ডাল, ছোলা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ আমদানি হয় চীন থেকে।

* ফিনিশ লেদার ও লেদার গুডস অর্থাৎ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য আঠা, ধাতব লাইনিং ও অ্যাক্সেসরিজের ৬০ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। এখাতে তিন হাজার কোটি টাকার মত ক্ষতি হবে।

* বাংলাদেশ থেকে সামুদ্রিক মাছ অর্থাৎ কাঁকড়া ও কুচে মাছ রপ্তানি হয়, এর ৯০ শতাংশই যায় চীনে

* ইলেকট্রিক্যাল, মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের ৮০-৮৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল চীন থেকে আসে,

* পাট স্পিনিং খাতে প্রতি বছর বাংলাদেশ চীনে পাট ও পাটজাত পণ্য ৫৩২ কোটি টাকার রপ্তানি করে। করোনা ভাইরাসের কারণে এখন ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা নিরূপণের কাজ চলছে।

* মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস ও হসপিটাল ইকুয়িপমেন্ট তৈরি শিল্পের যন্ত্রাংশ চীন থেকে আমদানি হয়,

* কসমেটিক্স অ্যান্ড টয়লেট্রিজ খাতে প্রতি মাসে ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি হয়, যা এখন বন্ধ রয়েছে।

এছাড়া ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল এবং চশমা শিল্পের বাজারও চীন নির্ভর। ট্যারিফ কমিশন বলছে এসব জায়গায় সরকারকে নজর দিতে হবে।


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/1784 ,   Print Date & Time: Saturday, 11 October 2025, 02:25:52 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh