• হোম > অর্থনীতি > লকডাউন বনাম কৃষক ও ভুখা মানুষের অর্থনীতি

লকডাউন বনাম কৃষক ও ভুখা মানুষের অর্থনীতি

  • মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০, ০৬:৫৯
  • ১০৪৮

লকডাউন বনাম কৃষক

মাহা মির্জা

কিছু অঙ্ক মেলে না। গত এক দশকে হুহু করে বার্ষিক মাথাপিছু আয় বেড়েছে বাংলাদেশের। ২০১০ সালে ছিল ৮২৫ ডলার। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০০ ডলার। বিরাট সাফল্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাথাপিছু মাসিক আয় ১৩ হাজার টাকার কিছু ওপরে। অর্থাৎ প্রতিটি পরিবারের ভাগে পড়ছে ৫৩ হাজার টাকা (৪ সদস্য ধরে)। মাত্র ২ সপ্তাহের লকডাউনে একটু গরম ভাতের আশায় ময়লা পরিবারগুলোর দীর্ঘ লাইন দেখে ভাবছিলাম, ১০ বছরে মাথাপিছু আয় শতকরা ১০০ ভাগ বেড়ে যাওয়ার এই অঙ্কটা দেখে হাসব না কাঁদব?

এর মধ্যে আবার ১০ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে এক লাখের বেশি। তিন কোটি ডলারের বেশি সম্পদ আছে, এমন ধনী বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে (ওয়েলথ এক্স, ২০১৮)। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো এক লাখ কোটি ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকের টাকা মেরে বড়লোক হওয়ার সংখ্যাও বেড়েছে। কাজেই কোন মাথাগুলোর আয় বেড়েছে জনগণ তা বোঝে।

গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। এর মধ্যে ৭ কোটি মানুষের অ্যাকাউন্টে গড়ে আছে মাত্র ৬১০ টাকা!

গড় হিসাব বলছে, মাসিক মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার টাকা, অথচ ৭ কোটি মানুষের এই হলো সঞ্চয়ের অবস্থা? এই যদি হয় অবস্থা, শুকনা মরিচ দিয়ে ভাত খেলেও তো একটা সপ্তাহ চলতে পারবে না একটা পরিবার। এমনিতেই পশ্চিমা দেশগুলোর মতো এখানে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বলতে কিছু নেই, তার ওপর হদ্দ গরিবের দেশ, এখানে খাদ্যের ব্যবস্থা না করেই ইউরোপ আমেরিকার স্টাইলে লকডাউন ঘোষণা করে দিলাম? আবার নিয়ম করে ১ হাজার ৯০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের গালগল্পও চালাচ্ছি। করোনাকালে যে উদোম হয়ে গেল উন্নয়ন।

সরবরাহ লাইন বিপর্যস্ত
লকডাউনে অচল গ্রামগঞ্জের পাইকারি বাজারগুলো। হাজার হাজার পরিবহনশ্রমিক বেকার বসে আছে। পাইকারি বাজার বন্ধ হয়ে গেলে কৃষকেরা তাঁদের খেত উপচে পড়া সবজিগুলো বেচবেন কোথায়? সরবরাহ চেইন তো ইতিমধ্যেই ধসে পড়েছে।

উত্তরবঙ্গে সবজির দাম নেই, টমেটোর কেজি ৫ টাকা, মরিচের কেজি ৩ টাকা, বেগুনের কেজি ২ টাকা, শসার কেজি ৫০ পয়সা! আবার পাইকারেরা সিন্ডিকেট করে খেত থেকে পানির দরে সবজি কিনছেন, আর খুচরা বাজারে ডাবল দামে বিক্রি করছেন। গতর খাটিয়ে কাজ করা সবল মানুষগুলোও দুর্বল হচ্ছে দিনে দিনে, কোনোমতে শাকপাতা খেয়ে টিকে আছেন, তার ওপর বাজারে সবকিছুর দাম চড়া।

সরকারের কাজটা কী বলুন তো? কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এগুলো ঠিক কাদের জন্য? আবহমানকাল ধরে বাংলার কৃষক অভাগা, ফসলের দাম পান না বুঝলাম, কিন্তু লকডাউন সফল করতে গেলেও তো খাদ্যের সরবরাহ চেইনটি সচল রাখা এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কাজ। গাইবান্ধার চাষি আমিনুল ইসলাম প্রায় কেঁদে ফেলে বলেছিলেন, রাস্তাঘাটে এত চোটপাট, তাহলে ট্রাক পাঠিয়ে আমাদের সবজিগুলো শহর পর্যন্ত নিয়ে যাক সরকার। নইলে তো গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে।

রাষ্ট্রযন্ত্র একটা টইটম্বুর যন্ত্র। এই যন্ত্রে পাইক পেয়াদা আছেন, থানা-পুলিশ, সচিব, উপসচিব, ইউএনও–টিএনওরা আছেন। তাঁদের বেতন দেয় জনগণ। তাঁদের কাজটা কী? লকডাউনের খবরদারির পাশাপাশি পাইকারি বাজারগুলোতে মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, এসব স্বাস্থ্যবিধির তদারকি করতে ঠিক কয় গন্ডা প্রশাসনের লোক লাগে? এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কাজ জেলা শহরের পাইকারি বাজারগুলো সচল রাখা (সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করে) এবং চালকদের নিরাপত্তা পোশাক দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ডিম, দুধ, সবজি পরিবহনের কাজে লাগানো। অথচ এক ধাক্কায় সিস্টেমের নাটবল্টুগুলো খুলে পড়ছে কেন? আমরা জানি, উপজেলা পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের কাছে এলাকার কৃষকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকে। আবার পৌরসভার অধীনে ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহনের সুবিধাও থাকে। আমরা এ–ও জানি, জেলায় জেলায় ইউএনও টিএনওদের জন্য ৯৪ লাখ টাকার পাজেরো কিউ-এক্সের বরাদ্দ ঠিকই আছে। আমরা জানতে চাই, নিজ নিজ এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে শস্য সংগ্রহ করা এবং পাইকারি বাজার ও পরিবহনব্যবস্থা সচল রাখতে জেলা শহরের পাজেরোওয়ালারা ঠিক কী কী করছেন?

আমরা পায়রা বন্দর নির্মাণ করছি সোয়া এক লাখ কোটি টাকা খরচ করে। দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লা আসবে ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্দামান ঘুরে রাবনাবাদ চ্যানেলে। বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল বন্দর হবে এটি। আমি ভাবছিলাম, ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্দামান ঘুরে রাবনাবাদ কত দূর? কত হাজার মাইল? আমরা তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে স্যাটেলাইট কিনেছি, সেটাকে পাঠানো হয়েছে মহাকাশের কক্ষপথে। যত দূর জানি, পৃথিবী থেকে জিওস্টেশনটির দূরত্ব ৩৫ হাজার কিলোমিটার।

আচ্ছা, ঢাকা থেকে ঠিক কত দূরে কুড়িগ্রাম? নীলফামারী থেকে খুব বেশি দূরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার? ডিমলা থেকে কত দূর আমিন বাজারের আড়ত?

খামারিদের অভিমানে ফেলে দেওয়া দুধ, পোলট্রি খামারগুলোতে পড়ে থাকা ডিম, বীরগঞ্জে কৃষকের ফেলে দেওয়া শসা, গাইবান্ধায় গরুর জন্য জমতে থাকা টমেটো, পটুয়াখালীতে পচতে শুরু করা তরমুজ, কুড়িগ্রামের খেতে পড়ে থাকা মিষ্টিকুমড়া আর লাউগুলো জেলা শহরের পাইকারি বাজারগুলো পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কয়টা ভ্যানগাড়ি লাগে? ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়টা লাগে ট্রাক? কত টাকার তেল পোড়ে? ইন্দোনেশিয়া থেকে আন্দামান হয়ে পায়রা বন্দরে কোটি কোটি টন বিষাক্ত কয়লা বয়ে আনতে যতটুকু তেল পোড়ে, তার চেয়েও বেশি?

সারা দেশের আনাচকানাচে ঘামের ফসল কোলে নিয়ে কৃষক চোখের পানি মুছছেন। আরেক দিকে ঢাকার রাস্তায় মলিন মুখে এদিক-ওদিক ঘুরছেন রিকশাচালক, পার্টসের মেকানিক, ফুটপাতের হকার— সব না খাওয়া। খামারিদের ডিম, দুধ আর কৃষকের সবজিগুলো দুর্যোগকালীন ত্রাণ হিসেবে কিনছে না কেন সরকার? কত টাকা লাগে? বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচের রাস্তাগুলো বানাতে জনগণের যত টাকা চুরি হয়ে গেছে ,তার চেয়েও বেশি?

বোরো মৌসুমের ধান ও গুদামের চাল
বৈশাখ–জ্যৈষ্ঠজুড়ে বোরো ধান কাটবেন চাষি। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দুই কোটি টন। এই মহাদুর্যোগের দিনে সরকার বাহাদুর ধান কিনবে নিশ্চয়ই? কত লাখ টন? জেনে আশ্চর্য লাগে, সরকার কেনে মাত্র ৫-৬ লাখ টন ধান। চালও কেনে সরকার, ১১ লাখ টন, তবে সেটা সরাসরি রাইস মিলগুলোর কাছ থেকে। সব মিলিয়ে মৌসুমের মোট ধানের ২-৩ ভাগ! আর বাকিটা? বাকিটা মানে বাকি ৯৭ ভাগ? বাকিটা কৃষক বুঝুক। দাম পড়ে গেলে? কৃষক বুঝুক। ফড়িয়া, আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগী? কৃষক বুঝুক। খেতমজুর-সংকট, ধান কেটে কুলোনো যায় না? কৃষক বুঝুক। লিজের টাকা পরিশোধ করে, বাজার থেকে চড়া দামে সার, বীজ, কীটনাশক কিনে কুলোতে পারে না বর্গাচাষি, প্রতিবছর লস খায়। আমাদের কী?

গুদাম উপচে পড়া ১৭ লাখ টন চাল নিয়ে বসে আছে সরকার। যথারীতি, বোরো মৌসুমে ধান উঠলে কৃষক ধানের দাম পাবেন না। সরকার ন্যায্য দামে ধান কেনার ঘোষণা দেবে এবং একপর্যায়ে ‘সরকারি গুদামে জায়গা নাই’, এই অজুহাতে সরাসরি ধান কেনার পুরো প্রক্রিয়াটাই তামাশায় পরিণত হবে। প্রতিবছর একই যুক্তি, ‘ক্যাপাসিটি’ নাই, গুদাম খালি নাই। সাধারণ বুদ্ধি বলে, বোরো মৌসুমের আগেই চালের গুদামগুলো খালি করা দরকার ছিল। ট্রাক ভরে ভরে সারা দেশের অভুক্ত মানুষের ঘরে চাল-ডাল পৌঁছে দেওয়া জরুরি ছিল। এটা দিনমজুরের দেশ, এখানে লকডাউন সফল করতে গেলেও তো নিম্ন আয়ের ঘরগুলোতে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু এর মধ্যে এক অদ্ভুত বাস্তবতার কথা জানলাম। সরকার চালের গুদাম অর্ধেক খালি করতেও ভয় পায়। কারণ, চালের ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দেয়! এর মানে কী দাঁড়াল? বাংলাদেশ রাষ্ট্র দিনের শেষে গুটিকয়েক চাল ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি! বাহ।

আমি ভাবছি, প্রায় ৪৭ লাখ হেক্টর জমির সমস্তটা বোরো ধান কিনে ফেলতে আসলেই কত টাকা লাগে রাষ্ট্রের? ঠিক কত টাকা লাগে সব জেলায় জেলায় ধান-চালের সরকারি গুদাম বানাতে? এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে শুনলাম, ৫ লাখ টন ধান মজুতের জন্য জেলায় জেলায় ‘কমিউনিটি স্টোরেজ’ তৈরি করার একটা প্রস্তাব খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ঘুরছে। অর্থাৎ কৃষকেরা নিজেদের ধান নিজেরাই ‘স্টোর’ করবেন। অথচ দুই বছর ধরে সেই ফাইল আর নড়ে না! ঋণ করে ঘি খাওয়া মেগা প্রকল্পের প্রস্তাবগুলো ধুমধাম পাস হয়ে যায়, আর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মাটিঘেঁষা প্রকল্প আলোর মুখ দেখে না! গ্রামগঞ্জে কৃষকের ‘স্টোরেজ’ সক্ষমতা বাড়লে ফড়িয়াদের কাছে জিম্মি থাকতে হয় না কৃষককে। প্রতিটা ইউনিয়নে ছোট বড় গুদাম তৈরি করতে কতই বা খরচ হয় বলুন তো? কিন্তু আমরা জানি, এই দেশে মেট্রো হবে, উড়ালসড়ক হবে, স্যাটেলাইট, সাবমেরিন হবে, কিন্তু কৃষকের জন্য দেশজুড়ে ছোট ছোট গুদাম হবে না। আমরা হাজার কোটি টাকা মেরে খাওয়ার দেশ। ছোট চুরিতে আর পেট ভরে না।

১৭ লাখ টন চাল পড়ে আছে গুদামে। প্রতিদিন ডিম দুধ নষ্ট হচ্ছে খামারে। আগামী কয়েকটা মাসের জন্য ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই। নইলে কারফিউসহ লকডাউন করেও ক্ষুধার্ত মানুষের ঢল থামানো যাবে না। আর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অভুক্ত ও অরক্ষিত রেখে এই করোনাকালে আপনারা বাঁচবেন না। তাই বাঁচতে চাইলে মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা করুন। তাদের এত দিনের শ্রম ও ঘামের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিন।

মাহা মির্জা: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/1764 ,   Print Date & Time: Friday, 6 June 2025, 05:44:47 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh