• হোম > ফিচার > করোনাভাইরাস কি স্থায়ীভাবে বিশ্ব পরিবর্তন করবে: চল একসাথে দূরে থাকি, বিশ্বাসে কাছাকাছি, দূরে দূরে কাছে থেকে দেশটাকে ভালোবাসি।

করোনাভাইরাস কি স্থায়ীভাবে বিশ্ব পরিবর্তন করবে: চল একসাথে দূরে থাকি, বিশ্বাসে কাছাকাছি, দূরে দূরে কাছে থেকে দেশটাকে ভালোবাসি।

  • বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল ২০২০, ১৭:৫৩
  • ১০৩৭

---

আশা ছাড়া কী-ই বা করার আছে এখন? অবশ্যই কর্মহীন ভাগ্যের হাতে সমর্পিত আশাবাদ নয়, প্রতিরোধ ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির লড়াই-এর আশাবাদ।

মনে পড়ছে ১৯২৩ সালে প্রকাশিত রুশ অভিযাত্রী ভ্লাদিমির আরসেনিয়েভের লেখা স্মৃতিকথা থেকে ১৯৭৫ সালে। তাঁদের অভিযাত্রী দলের কাজ ছিল ভবিষ্যৎ নগরায়ণের জন্য নতুন নতুন দুর্গম বনভূমি  ও সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর সংগ্রহ করে আনা।

সেখানেই একাকী বৃদ্ধ বনজীবী ডেরসুর সঙ্গে রুশ অভিযাত্রীর সাক্ষাৎ। বরফের গর্তে পড়ে যাওয়ার ঘোর বিপদ থেকে অভিযাত্রীকে বাঁচায় ডেরসু। ভয়ঙ্কর বরফ-ঝড়ে হাতের কাছে পাওয়া ঘাসপাতা দিয়ে মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয় বানাতে শেখায়।

নির্মম কঠোর প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগে সে ছিল এক অদম্য বাঁচার লড়াই। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বা তাকে পর্যুদস্ত করে নয়, নিজেকে যথাসম্ভব রক্ষা করাই ছিল ডেরসুর শিক্ষা।

প্রকৃতির সংহারমূর্তির উল্টো দিকে মানুষের ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করে টিকে থাকার এই গল্পে দুই অসমবয়সি ও অসম শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব শ্রদ্ধা গড়ে ওঠার কাহিনিও ছিল।

ওই জঙ্গল, বরফ-প্রান্তরের প্রতিটি বিপদের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য আশ্রয়ের কথা ওই স্থানীয় জনজাতির মানুষটির নখদর্পণে। দেখেছিলাম সেই চলচ্চিত্রে, নাগরিক ‘অভিযাত্রী’ এবং গ্রামীণ স্বশিক্ষিত মানুষটির মধ্যে কত অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি করেছে মানবসভ্যতা!

আজ আর এক বার নিজেদের চার পাশে সেই দূরত্বের ঘেরাটোপ। নিম্নবিত্ত সাধারণ বাংগালীর প্রতি ‘আমরা’ আজ শ্রদ্ধা সহানুভূতি হারিয়ে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। পদব্রজে যাঁরা হাজার মাইল অতিক্রম করছেন, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমরা তাঁদের জন্য হাততালি দিচ্ছি, মধ্যিখানে ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’। তাঁরা বলতেই পারেন, অসুখটা আপনারা এনেছেন, আমরা না। তাই লকডাউন আমরা না মানলে, তাতে যদি আপনাদের ক্ষতি হয়, তাতে আমাদের কী? আমরা তো দু’দিকেই মরে আছি!

প্রতিটি মানুষ একটি গল্প। প্রতিটি গল্প জুড়ে তৈরি হয় মানববন্ধন। যেমন আমরা পড়েছিলাম কিউবার অবরোধের সময় বাড়ির বারান্দায় মাটি ফেলে সবজি ফলানোর প্রতিরোধ। শুনেছিলাম ভিয়েতনামেও। বিখ্যাত ভিয়েতনাম ট্রেল-এর পাশ ধরে হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম এক সমুদ্রবন্দরে।

মাইল মাইল ফসল নষ্ট করা হয়েছিল আকাশ থেকে ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ছিটিয়ে, তবুও দমানো যায়নি তাঁদের। বৃক্ষ কেটে নিয়ে গিয়েছিল জাপানিরা। বাইরে থেকে বৃক্ষ এনে বিশেষ পদ্ধতিতে লাগিয়েছিলেন ভিয়েতনামের মানুষেরা। এমন হাজার দেশের হাজার প্রতিরোধের গল্পে ভরে আছে আমাদের স্মৃতি। জানি, জারি আছে মানবতা প্রতিষ্ঠার লড়াই।

তেমনই, আজ আমাদের দেশের নানা ধরনের মানুষ, যত দূর পারছেন, লকডাউন সহ্য করছেন। বেশির ভাগ খেতে-পাওয়া কর্মী মানুষ সাবধানবাণী গ্রাহ্য করে বাইরে বেরোচ্ছেন না। নিরুপায় মানুষের কথা আলাদা। কোথাও কোথাও শুনছি স্থানীয় ভাবে সমাধানের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন যাইগায় মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বস্তায় বস্তায় চাল-ডালের সাহায্য দেওয়া হচ্ছে।

জীবনের রিক্স নিয়ে গার্মেন্টস কর্মীরা কাজ করছে। সাংবাদিকরা বলছে আপনি ঘরে থাকুন, আমরা বাইরে আছি। কোনও দলই বিরুদ্ধ মত পোষণ করেননি। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে নিয়ম মেনে কাজ করছেন । প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে, সরকারি-বেসরকারি সব তরফের প্রচারে কাজ দিয়েছে, সকলে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। মাল পরিবহণকারী রেল কিম্বা ট্রাক মাল পরিবহণ করছে।
আর্মি, পুলিশ, ট্রাফিক, সকলে মিলে যথা সাধ্য চেষ্টা করছে পরিস্থিতি সামাল দিতে।

এ সবই হল আশার গল্প। আমাদের আঁকড়ে ধরার খড়কুটো। সব যদি পুরোপুরি কার্যকর নাও হয়, কিছু তো কাজ হবে। হাল ছাড়তে বাধা তো দিতে পারে এই গল্পগুলি!

তবে এসবের ভিতর অতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চির চেনা পৃথিবীতে আমাদের আবার নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে।

আমি নাকি আমরা - ভাইরাস কী আমাদের চির চেনা সমাজ বদলে দিচ্ছে?

কোভিড -১৯ মহামারী সারা বিশ্ব বিশেষ করে ইউরোপের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে একটি বড় রকমের চাপ সৃষ্টি করছে: হাসপাতালগুলি রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে, স্কুল এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে এবং পুরো ব্যবসায়িক ক্ষেত্রগুলি পঙ্গু হয়ে পড়েছে, যা সমগ্র জনগণের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে দাঁড়িয়েছে।
কেমন হবে আগামীর পৃথিবী? আগের সমাজ, রাষ্ট্র, ক্ষমতা কি আগের যাইগায় থাকবে? না কি আসবে পরিবর্তন?
এসব চিন্তার উত্তর পাওয়া খুব জরুরি।

দূরত্ব বজায় রাখা কিন্তু সব একসাথে

করোনাভাইরাসের কারণে কয়েক মিলিয়ন ইটালিয়ান বাড়িতে থাকতে হচ্ছে, তবে তারা ব্যালকনিগুলিতে একসাথে সংগীত পরিবেশন করে এবং ডাক্তারদের সাধুবাদ জানায়।

এটিকে পরিচ্ছন্ন দেশপ্রেমের উদাহরণ, তারা মনে করছেন :

“আমরা প্রতিটি ব্যক্তির স্বাস্থ্যের জন্য প্রযোজ্য নিয়মকে সম্মান করি, সুপারমার্কেটের বাইরের কাতারে দাঁড়িয়ে যখন আমরা একে অপরের থেকে আমাদের দূরত্ব বজায় রাখি, অন্যথায় আমরা জরিমানার মুখোমুখি হই তা নয়, কারণ আমরা জানি যে এটিই কেবলমাত্র আমরা অস্ত্র, জিততে হবে। আমরা নাগরিক, প্রজাদের নয়। পুলিশ এবং নার্সদের জন্য করতালি দিচ্ছে তারা এবং তাদের কাজের জন্যে গর্ব করছে সবাই। তারা আজ আমাদের চ্যাম্পিয়ন, আমাদের জাতীয় দল। এতটা ইতালিবাসী বারান্দা থেকে বারান্দা পর্যন্ত ‘নেল ব্লু ডিপিন্তো ডি ব্লু’, ‘আজজুরো’ বা ‘ভিভা এল ইটালিয়া’ জাতীয় সংগীত গাইতে দেখতে কত অবাক লাগে ”

রাজ্যের প্রত্যাবর্তন

মহামারীটি রাজনীতি এবং ব্যবসায়ের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে সংশোধন করেছে, কলামিস্ট বার্ট ওয়েজেনডর্প নোট ভোলসক্র্যান্টে সন্তুষ্টির সাথে বলেন:

“রাষ্ট্র ফিরে এসেছে। জনগণের অভিভাবক এবং জনস্বার্থ, দেশের ত্রাণকর্তা এবং ব্যবসায়ের উদার দাতা হিসাবে। নিওলিবারেল অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত, বাজারে পবিত্র বিশ্বাস, বা ব্যক্তিবাদ এবং স্বার্থের অভিবাদনমূলক প্রভাবের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনেনি। ফ্রি মার্কেট যতক্ষণ অর্থোপার্জন করতে পারে ততক্ষণ কাজ করে তবে সংকটে এটি অনেক দূরে। এখন, আশা করি, করোনাভাইরাস এই নীতিটি চূড়ান্ত মৃত্যুর আঘাতের মুখোমুখি হবে।

ম্যাক্রন হঠাৎ বাম দিকে ঘুরলো

ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি টেলিভিশনে ঘোষণা করেছিলেন যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিঃশর্ত রাষ্ট্রীয় সমর্থন। তার আগের নীতিগুলির সাথে একটি দুর্দান্ত বিরতিকে উপস্থাপন করে, লে পয়েন্ট যুক্তিযুক্ত:

“কোভিড -১৯ এখন সামাজিকভাবে উদার বিশ্বায়নের অ্যাডভোকেট। এমমানুয়েল ম্যাক্রোন, যিনি এখন কল্যাণ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার পক্ষে, বাজারের অর্থনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, সুরক্ষাবাদের সুবিধাগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন এবং ইসিবির নীতিগুলিকে আক্রমণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন, সেই ব্যক্তির পক্ষে তিনি আরেকটি শিকারের দাবি করেছেন। যা তিনি অত্যন্ত অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন। বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্রপ্রধানের কথা শুনে একজন আশ্চর্য হয়ে যায় যে, সমাজতান্ত্রিক দল শেষ পর্যন্ত পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী খুঁজে পায়নি কিনা। ”

পশ্চিমের মান ব্যবস্থার জন্য একটি পরীক্ষা

নীতিশাস্ত্রের অধ্যাপক মার্টিন বোমস এনজেডজেড-এ ইতিমধ্যে অস্থির-পশ্চিমা-উদারপন্থী সমাজের সঙ্কটের পরিণতিগুলি প্রতিফলিত করেছেন:
“করোনাভাইরাস সংকট কেবল তখনই কাটিয়ে উঠবে যখন লোকেরা মূল্য বিবেচনায় নজর রাখবে এবং সম্মতি জানাবে যে তারা যখন স্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করে তখন তাদের নিজস্ব স্বার্থ সবচেয়ে উন্নত হয়। … যদি আমরা এই চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হই তবে এমন বিপদ রয়েছে যে কোনও সময়ই ভাইরাসটি উদার পশ্চিমা কাঠামো এবং উদার পশ্চিমা বিশ্বদর্শনকে ধসের পয়েন্টে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে না। … আমরা যদি আবারও পশ্চিমা-উদার বোঝার ভিত্তিতে মনোনিবেশ করতে পারি, তবে এই জৈবিক বিপর্যয়ই শেষ পর্যন্ত সমাজের জন্য একটি সুযোগ হয়ে উঠবে। “


This page has been printed from Entrepreneur Bangladesh - https://www.entrepreneurbd.com/1489 ,   Print Date & Time: Friday, 6 June 2025, 07:48:26 PM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 Entrepreneur Bangladesh